নব্বই দশকের প্রথমার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ উৎপাদন তথা আর্থিক খাতে যুগোপযোগী আইন প্রবর্তন, নীতি নিয়ম পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধিত হওয়ার ফলে রাজস্ব আহরণের উপায় উন্নতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। মূসক আইন প্রবর্তনসহ বেশ কয়েকটি রেগুলেটরি সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে কর রাজস্ব আহরণের প্রকৃতি বিস্তৃত হয় ও সার্বিক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৭-৮৮ সালে জিডিপি ৫৯৭ বিলিয়ন থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১২৫৪ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২০০২ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয় এ দশকেই। ভোগ জিডিপির রেশিও ১৯৮৭-৮৮ সালে সেখানে ছিল ৯৭%, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৭.৭% এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ৮২.৬%-এ নেমে আসে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জাতীয় সঞ্চয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১০.৭ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৮.০ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২১.৮-এ উন্নীত হয় এবং মোট বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১১.৮ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৭.৯ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২১.৬-এ উন্নীত হয়। এর প্রভাব প্রতিফলন ঘটে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিতে-১৯৮৭-৮৮ সালে এনবিআর অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৯.৫ বিলিয়ন টাকা, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৬.৪ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ১৩৮ বিলিয়ন টাকায় বৃদ্ধি পায়। কর রাজস্ব আয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালের ৮.৭% থেকে ১৯৯২-৯৮ সালে ৮.৮% এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে তা ৯.৪%-এ উন্নীত হয়। এরপর অবশ্য কর জিডিপি ও রেশিও আর তেমন বাড়েনি। মূলত কাছাকাছি থাকে। এর অর্থ হলো অর্থনীতিতে আয়-ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও কর রাজস্ব আয় সমানুপাতিক হারে বাড়েনি। সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু (এপিসেন্টার) সেখানেই।
নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮৭-৮৮ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ২৯৮৬ মি:মা:ড:, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৩৯৮৬ মি:মা:ড: এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ৭৫৪৫ মি:মা:ড:-এ পৌঁছায়। অপরদিকে যে রপ্তানি ১৯৯৭-৯৮ সালে ১২৩১ মি:মা:ড:, ১৯৯২-৯৩ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ ২৩৮৩ মি:মা:ড: এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে রেকর্ড ৫১৬১ মি:মা:ড:-এ দাঁড়ায়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অতি প্রাগ্রসরমান এ তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যান নির্দেশ করে একটি দ্রুত গতিশীল অর্থনীতির এবং সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয়, বৃদ্ধি পায় আমদানি শুল্ক, আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর আহরণের ক্ষেত্র বিস্তৃতির অবকাশ। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য যে এ দশকে আমদানি রপ্তানি শুল্ক ও মূশক তথা কাস্টমস বিভাগে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেলেও আয়কর বিভাগের আয়ে অগ্রগতি সমানুপাতে আসেনি।
বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটি স্বয়ংক্রিয় ও যুক্তিযুক্ত ভিত্তি প্রক্রিয়ার ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে নব্বই দশকের প্রথমার্ধে গঠনমূলক বেশকিছু উদ্যোগ গৃহীত হলেও পরবর্তীকালে সে সব প্রয়াস প্রচেষ্টায় যথাযথ ফলোআপ ছিল না। ফলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে রাজস্ব আহরণের আওতায় আনতে শুধু বেগ পেতেই হয়নি বা হচ্ছে না এখানে বেশকিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও অনুপ্রবেশ করে। শুল্ক হার নিরূপণ নির্ধারণে ট্যারিফ কমিশনের তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি সরবরাহের প্রশ্নে এনবিআর-এর সঙ্গে ট্যারিফ কমিশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বেড়ে যায়, যোগাযোগ হ্রাস পায়। আমদানি পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ ও শুল্কায়নের স্বার্থে প্রাক জাহাজীকরণ ইন্সপেকশন পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ে শুল্ক বিভাগ। এখানে বিদেশি ভেন্ডরদের বাংলাদেশে এই কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও অনিয়ম এখানে যুগলবন্দি হয়ে ওঠে। পিএসআই কোম্পানিগুলোর দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতির মহড়া দেখা যায়। এনবিআরের লোকবল ও কর্মপদ্ধতির উন্নয়ন অভীপ্সায় বিশেষ করে ভ্যালুয়েশন এবং শুল্কায়নে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং ডিএফআইডির অর্থায়নে বেশ কয়েকটি গুচ্ছ প্রকল্প (যেমনÑ কাস্টমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মডার্নাইজেশন বা ক্যাম; এক্সাইজ, কাস্টমস, ট্যাক্সেশন (ইটাক) ডাটা কম্পিউটারাইজেশন;) বাস্তবায়নের মহড়া শুরু হয় এ দশকেই। এসব প্রকল্প মেয়াদান্তে শেষ হলেও তাদের রেখে যাওয়া সুপারিশ, প্রবর্তিত পদ্ধতি সফটওয়ার প্রয়োগ বাস্তবায়ন ফলাবর্তনে সব সময় সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ও স্ট্রাকচারাল রিফর্মস প্রোগ্রামের মধ্যে শর্ত (ট্রিগার) আরোপ করে তার বাস্তবায়নে চাপ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুসরণেও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি।
এটা লক্ষণীয় নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রসার প্রত্যক্ষ করা গেলেও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব আহরণকারী দপ্তর এনবিআরের সক্ষমতা ও দক্ষতা সমহারে বাড়েনি বা বাড়ানো হয়নি। অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা সংযুক্ত হলেও তার সঙ্গে বিদ্যমান রাজস্ব আইনগুলোকে যুগোপযোগীকরণের কাজে প্রত্যাশিত মনোযোগ ও তৎপরতা একই সমতলে লক্ষ্য করা যায়নি। বরাবরই সীমিত লোকবল ও সীমাবদ্ধ খাত ক্ষেত্র থেকে রাজস্ব আহরণে নিবদ্ধ থাকতে হয়েছে এনবিআরকে। একই সঙ্গে উদীয়মান শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার নাম করে, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণের উপায় ও উপলক্ষ হিসেবে ব্যাপকভাবে কর অবকাশ এবং কর রেয়াত দেওয়ায়, পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে ঋণ কিংবা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের পরিচালিত মেগা প্রকল্পগুলোতেও রাজস্ব অব্যাহতি দেওয়া কাক্সিক্ষত ও বাঞ্ছিত কর রাজস্ব আহরণ বাড়েনি। বরং এসব উদ্যোগে করের খাত ক্ষেত্র বিস্তৃতির পরিবর্তে সংকোচিত হয়েছে। যে কোনো উদীয়মান অর্থনীতিতে শিল্প উৎপাদন বাণিজ্য বিনিয়োগ বিবরে সুরক্ষার নামে প্রথম পর্যায়ে প্রণোদনা ও কর রেয়াত প্রদানের চাপ থাকে, থাকলেও একই সঙ্গে উদীয়মান করদাতাকে কর জালের মধ্যে আনার উদ্যোগে তেমন মনোযোগ যথাসময়ে আরোপিত না হওয়াটা বা এ ব্যাপারে ব্যর্থতা বা অপারগ পরিস্থিতি বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এনবিআরের সক্ষমতা সে কারণে না বাড়ানোর ফলে প্রত্যক্ষ কর আহরণ ব্যবস্থাপনা জোরদার হয়নি যা পরবর্তীকালে পরোক্ষ করের অগ্রগতি সত্ত্বেও সমতালে বৃদ্ধি পায়নি এবং যা এখনো একমাত্র বাংলাদেশে ব্যতিক্রম, প্রত্যক্ষ কর থেকে অর্জন পরোক্ষ করের তুলনায় কম। ফলে দেশের কর জিডিপি রেশিও সামাঞ্জস্যতায় আনয়নে, সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নব্বইয়ের দশকে রাজস্ব আহরণের যে নবযাত্রা শুরু হয় তা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তবে তা থেকে উত্তরণের জন্য তৎকালীন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সরকারগুলোর যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাকে আরও গতিশীল রাখার সময়, সুযোগ ও অবকাশ কিন্তু এখনো রয়ে গেছে।
প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, বৈষম্য বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে-সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতি-নির্ধারকের সঙ্গে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উৎপাদনকারীর সঙ্গে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সঙ্গে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের। সমাজে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুসের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রস্তুত এবং বৈষম্য বিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এই অগ্রগতি গুণগতমান উন্নয়ন ব্যতিরেকে শিক্ষার পাসের হার বৃদ্ধির মতো সাময়িক তৃপ্তি লাভের অগ্রগতি মনে হতে পারে- ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয়- সাময়িকভাবে, নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী একটি স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু যে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল এবং মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতি আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসা অবয়বে উৎসাহিতবোধ করা চলে না। সেগুলো ক্রমশ নির্বাসনে পাঠিয়ে সাময়িক সেই প্রগল্ভতায় সমাজ প্রকৃতপক্ষে এগোয়নি বরং পিছিয়েছে। তার একটা সালতামামি প্রয়োজন।