খুব দ্রুততম সময়ে সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে চীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বশক্তিকেই সুপার পাওয়ার হিসেবে গণ্য করা হলেও এখন পরিস্থিতি বদলেছে। যুক্তরাষ্ট্র বাদে বাকি দেশগুলো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব হারানোর ফলে বদলে গেছে মহাশক্তিধর দেশের মানচিত্র। আশার বেলুন ফুটো হয়েছে জাপানের পরাশক্তি হবার সম্ভাবনা। সেই জায়গায় বিস্ময়করভাবে জায়গা করে নিয়েছে চীন।
মাত্র সাড়ে চার দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মহাশক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে চীন। পূর্ব এশিয়ার দেশ চীন এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ১৩৮ কোটি জনসংখ্যার দেশ। নানা শক্তিতে বলিয়ান চীনকে এখন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু ভাবা যায়, মাত্র ৪৫ বছর আগেও যেই দেশটিতে দারিদ্র্যতার হার ছিল ৬০ শতাংশের বেশি, সেই চীনই এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। যদিও মাঝখানে যুক্তরাষ্ট্রকেও টপকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সেরা স্থানে পৌঁছে গিয়েছিল চীন। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার ১২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ একটা সময় ছিল, কৃষিকাজ ছাড়া কিছুই জানতো না চীনের মানুষ। এমনকি ১৯৭০ সালে যখন বিশ্ব শিল্প উন্নয়নের চরমে, তখনও কৃষিতে মশগুল ছিল দেশটি। অথচ সেই দেশটি এখন বিশ্বের সৌর ও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তির পথ পদর্শক। বিশ্বের ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ এখন চীন। হাইড্রলিক বিদ্যুৎ উৎপাদনেও দেশটি বিশ্বে শীর্ষস্থানে। বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারেও বিশ্বে বড় ভূমিকা রয়েছে দেশটির। উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হওয়ায় দেশটির শিল্প-কারখানাকে কখনো লোড-শেডিংয়ে পড়তে হয় না বললেই চলে।
দারিদ্র্যতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে কিভাবে সুপারপাওয়ার হয়ে উঠলো চীন? সেই আলোচনা এখন সর্বত্র। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৯৮১ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে চীনের দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এই ৩২ বছরে দেশটির ৮৫ শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্যসীমা নিচে থেকে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে চীনা সরকার। পরের ৮ বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ২ শতাংশে। এভাবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দারিদ্র্যতার হার এক শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয় চীন। বিস্ময়কর এসব উত্থান শুধু চীনের সাফল্যকেই শীর্ষস্থানে নিয়ে যায়নি, এখন ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্বের অন্যতম সেরা পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও।
মাত্র চার দশকে বিশ্ব অর্থনীতির মোড়লে পরিণত হয়েছে চীন। তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক না হয়েও বিশ্ব বাণিজ্যের বড় অংশই এখন চীনের দখলে। কৃষি নির্ভরতা কাটিয়ে শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের চেষ্টায় বেশ ভালভাবেই সফল হয়েছে দেশটি। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হারে বাড়তে থাকে। ঐ সময়ে চীনে আমেরিকার বড় বড় বিনিয়োগ আসে। অ্যাপল বা স্যামসাং এর মতো বিশ্বখ্যাত টেক ব্র্যান্ডের হাব বা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় চীন। দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে টেক জায়ান্টের পাশাপাশি তুলা উৎপাদনে সফলতার গল্পগাঁথায় তৈরি পোশাক, বস্ত্র উৎপাদন এবং রপ্তানিতেও সেরা স্থান দখল করে দেশটি। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা এবং হাতে কলমে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশিক্ষিত করে দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতির শিখরে নিয়ে যায় চীন। দেশটিতে সফলতার অন্যতম কারিগর প্রায় ৮৫ কোটির মতো কর্মদক্ষ মানুষ।
২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিও’র সদস্যপদ লাভের পর বিশ্ববাণিজ্যে শুল্ক ও বাধামুক্ত পরিবেশে ব্যবসা চুম্বক গতিতে এগিয়ে নেয় চীন। ব্যবসা ও বিনিয়োগে আস্থার মডেল হওয়ায় খুব দ্রুত চীনা পণ্য ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। চীনা পণ্য ছাড়া বিশ্বের সব দেশই প্রায় অচল বলা যায়। বিশ্বের ৫০ শতাংশের বেশি মোবাইলের বাজার এখন চীনের দখলে। একইভাবে বিশ্বের ৫০ ভাগ কয়লা যায় চীন থেকে। জাহাজ নির্মানেও ৪০ শতাংশ বাজার চীনের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বের খেলনার বাজার, সিমেন্টের বাজারও চীনের দখলে। পিছিয়ে নেই সামরিক শক্তিতেও। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পর বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি এখন চীন। বিশ্বের ২৫ শতাংশ খাদ্য উৎপাদনও হয় পূর্ব এশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা চীন সভ্যতায়। শিক্ষা, প্রযুক্তি আর সামরিক শক্তির অভাবনীয় সাফল্য দিয়ে বিশ্বে এখন সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় চীন।