সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলাদেশের অর্থনীতির এক গেম চেঞ্জার এবং অসামান্য অবদান রেখেছেন, যার মাইলফলক ব্যবসায়িক যাত্রা ৩৪টি শিল্পে পরিণত হয়েছে। সুফি মীজানুর রহমান একজন ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তার চাকরি ছেড়ে দেন। পরিবর্তে, তিনি হাতে ১,৪৮৩ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তারপর, তিনি জাপান থেকে গাড়ির টায়ার আমদানি করেন এবং প্রথমবার একজন এজেন্টের মাধ্যমে সেগুলি বিক্রি করেন। এরপর সুফি মীজানুর রহমানকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জামাকাপড়, খাদ্য, যন্ত্রপাতি, গুঁড়ো দুধ, তেল-যা কিছু সে আমদানি করে, তাতেই সাফল্যই পান।
সূচনা
কর্মজীবন
পিএইচপি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা
করোনার ধাক্কা
সম্মাননা
পুরস্কার
সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান -এর জীবনী এক নজরে | |
নামঃ সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
|
শিক্ষা স্বীকৃতি ও পুরস্কারঃ – কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে দৈনিক পূর্বকোণ এবং গ্রামীণফোন কর্তৃক ‘প্রাইড অফ চট্টগ্রাম’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক। |
কর্মজীবন
সুফি মীজানুর রহমান নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে স্নাতকের ছাত্র ছিলেন।
১৯৬৫ সালে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে বিকম পাস করেন। পাস করার পরই ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করলেন।
১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন চাকরিরত অবস্থায়।
মাত্র বিয়ের এক মাস পর ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমান পূবালী ব্যাংক) নিয়োগপত্র চলে আসে হাতে। তৎকালীন সময়ে ব্যাংকিং নিয়মের জটিলতায় তাকে একটু কষ্ট করতে হয়। তখন এক ব্যাংকের লোক আরেক ব্যাংকে যোগদান করতে পারত না। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তারা তাঁকে যোগদানের সুযোগ দিলেন। ১৯৬৭ সালের বছরের শেষের দিকে বেতন মাসে ৮০০ টাকা তৎকালীন পূবালী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে যোগ দেন তিনি।
পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাপটে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে।ব্যাংকের স্বার্থ ঠিক রেখে সুফি মিজানুর রহমান বাঙালি ব্যবসায়ীদের স্বল্প পরিসরে পণ্য আমদানির সুযোগ করে দিতেন। প্রায়ই সময় তিনি বিশ্ববাজারে দাম আর স্থানীয় বাজারের দাম পর্যালোচনা করতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাঙালি ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে তাদের সুবিধার্থে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করলেন। একদিনে অস্বাভাবিক ঋণপত্র খোলার কারণে তদন্তও হয়েছিল। তিনি পার পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন সুফি মিজানুর রহমান।
তিনি বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেন ব্যাংকে আমদানি-রপ্তানির কাজ করতে গিয়ে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি হয়। স্বাধীনতার আগে বাঙালি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এমনিতেই ছিল কম। বাজারে চাহিদা ব্যাপক তখন পণ্যের, আমদানিকারক কম তার তুলনায়। কোনো পণ্যের আমদানিতে কখন কেমন লাভ হতে পারে, তা জানতেন তিনি ব্যাংকের বৈদেশিক শাখায় কাজ করার সুবাদে । এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন সুফি মিজানুর রহমান। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিলেন। বাবার পরামর্শও ছিল—ব্যবসা জানলে টাকা তোমার পেছনে দৌড়াবে।
তখন ব্যাপক চাহিদা বাজারে জাপানের ব্রিজস্টোন টায়ারের। তাই টায়ার-টিউব আমদানি প্রথম ব্যবসা হিসেবে বেছে নিলেন । ব্রিজস্টোনের এজেন্ট ইস্টার্ন মোটরসের মাধ্যমে টায়ার আমদানি করেন। এমন শর্তে ইস্টার্ন মোটরস এই সুযোগ দিল যে মুনাফার অর্ধেক ভাগাভাগি করতে হবে । শূন্য মার্জিনে ব্যাংকও ঋণপত্র খুলে দিল। প্রথমেই ব্যাংকের টাকা শোধ করলেন টায়ার বিক্রি করে । প্রথম ব্যবসায় ভালো মুনাফা হলো। পণ্য আমদানি শুরু করলেন একের পর এক । আমদানি করতে থাকলেন জার্মানি, ডেনমার্ক কিংবা হল্যান্ড থেকে গুঁড়া দুধ, চীন থেকে স্টেশনারি ও সুতা, ব্রাজিল থেকে চিনি, ভারত ও মিয়ানমার থেকে চাল।
তিনি শুরুর পর লাভের টাকায় দোকান কিনে নেন ঢাকার মৌলভীবাজারে। বাল্যবন্ধু মোহাম্মদ রুকুনউদ্দিন মোল্লা ও সহধর্মিণী তাহমিনা রহমানের বড় ভাই এতে অংশীদার হন। তিনি পণ্য কিনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার মৌলভীবাজারে পাঠাতেন। ঢাকায় বাল্যবন্ধু সেসব পণ্য বিক্রি করতেন।
প্রথমে জাহাজভাঙা কারখানা শুরু করলেন ছোটবেলার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। জাহাজভাঙা কারখানা গড়ে তুললেন সীতাকুণ্ডের উপকূলে বঙ্গোপসাগরের তীরে আর এম শিপব্রেকিং নামে। ১৯৮২ সালে প্রথম আমদানি করে ছয় লাখ ডলারে ‘ওশান এইচ’ নামে ভাঙলেন ছয় হাজার টনের পুরোনো জাহাজ কারখানায়। প্রথম আমদানি করা জাহাজ ভেঙেও পেলেন লাভের দেখা। দুই বছর পর লোহার প্লেট থেকে রড তৈরির কারখানাও দিলেন জাহাজভাঙা কারখানায়। নাম দিলেন সিনো বাংলা রি-রোলিং মিলস। মাসে ৪০০ টনের উৎপাদন ক্ষমতা। শুরুতেই লাভের দেখা মিলল এ কারখানায়ও। এরপর কারখানা স্থাপনের চিন্তা মাথায় এলো। ১৯৮৪ সালে মোংলা ইঞ্জিনিয়ার্স নামে এই বিলেট কারখানা তৈরি করলেন। পরপর একে একে গড়ে তুললেন ঢেউটিন, ভোজ্যতেল ও সুতার কারখানা। ঢাকায় এসব কারখানা গড়ে তোলেন। আর এম নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন । নিজের নামের প্রথম অক্ষর ও অংশীদারের নাম নিয়ে গ্রুপের নাম হলো। শুরুতে জাহাজভাঙা ছাড়া সব কারখানা ঢাকাতেই ছিল। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দিলেন ঢেউটিন তৈরির কারখানা—সি আর কয়েল মিলস।
পিএইচপি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা
ব্যবসা সম্প্রসারণ সময় ভাগ হয়ে গেল আর এম গ্রুপ । সুফি মিজানুর রহমানের ভাগে পড়ল জাহাজভাঙা কারখানা, অক্সিজেন কারখানা ও রাবার বাগান। ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই তিনি গঠন করলেন আলাদা কোম্পানি। নাম দিলেন (পিএইচপি) সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।
প্রথম প্রতিষ্ঠান ছিল পিএইচপি গ্যালভানাইজিং ইন্ডাস্ট্রি নতুন নামে যাত্রা শুরুর পর। দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়েছে এই ব্যবসা দাড় করাতে তাঁকে। বড় বিনিয়োগে কারখানা করতে থাকলেন। ২০০৫ সালে দেশে প্রথম প্রতিফলিত কাচের বড় কারখানা ‘পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে তোলা হয় পিএইচপির হাত ধরে । ফেনীতে আড়াই লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতার নতুন কারখানা গড়ে তোলা হয় পুরোনো ঢেউটিন তৈরির কারখানার পাশাপাশি । ২০১৭ সালে তাক লাগিয়ে দিয়েছে পিএইচপি মালয়েশিয়ার প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়ি সংযোজন করে।
দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে পিএইচপি কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা শিল্পকারখানার জন্য । প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে তার নিজের গড়া জাহাজভাঙা কারখানা । মেরিটাইম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এই কারখানার জন্য। পরিবেশবান্ধব ঢেউটিনের জন্যও সুনাম অর্জন করেছে পিএইচপি। দেশেই ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে এই শিল্প পরিবার।
করোনার ধাক্কা
২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় প্রায় ৪০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে করোনার সময়ে । তারপরেও একজন কর্মীকেও ছাঁটাই করেনি এই শিল্প পরিবার। তখন সুফি মিজানুর রহমান ঘোষণা দিলেন, করোনায় ছাঁটাই করা হবে না কাউকে। কথার প্রমাণ দিলেন কাজে। করোনার সময় ১২টি বোনাস দিয়েছেন কর্মীদের। বেতন-ভাতা তুলে দিয়েছেন মাস শেষ হওয়ার আগের দিন।
সম্মাননা
-বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-এ ইন্দোনেশিয়ার সম্মানসূচক কনসাল।
-আল্লামা রুমি সোসাইটি, চট্টগ্রাম ও সুফি মীজান ফাউন্ডেশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
-চট্টগ্রাম টেলিভিশনে ‘ইসলাম অ্যাজ আ রিলিজিয়ন অ্যান্ড ইটস ফিলোসফি “এবং এটিএন বাংলায়’ তাসাউফ”-এর বক্তা।
-রোটারি ক্লাব অব আগ্রাবাদের সভাপতি, চট্টগ্রাম।
-চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি।
-চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য।
-পল হ্যারির ফাউন্ডেশনের ফেলো।
-ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক (IUB)।
পুরস্কার
-মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ২০০৩ সালের “বিজনেস পার্সন অব দ্য ইয়ার” সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
– কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে দৈনিক পূর্বকোণ এবং গ্রামীণফোন কর্তৃক ‘প্রাইড অফ চট্টগ্রাম’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়।
– প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক।
“ঐশ্বরিক আশীর্বাদের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমের সংমিশ্রণে ভালো উদ্দেশ্য অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারে”-মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
একজন সফল ব্যবসা এবং শিল্প উদ্যোক্তা হিসাবে তাঁর নাম এবং খ্যাতি ব্যবসায়িক বৃত্তের মধ্যে প্রসারিত হয়েছে। এছাড়াও, তিনি শিক্ষা এবং ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনার প্রায় সমস্ত শাখায় একজন দক্ষ প্রশিক্ষক এবং সাবলীল বক্তার মতো বহুমুখী গুণাবলি অর্জন করেছিলেন। তবে এটিই শেষ নয়।
তিনি একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেও উল্লেখযোগ্য, যিনি তাঁর দৈনন্দিন জীবনে কঠোরভাবে সুফিবাদকে অনুসরণ করেন এবং উপমহাদেশে মানবজাতির জন্য তাসফ (সুফিবাদের দার্শনিক পথ) প্রচার করেন।
দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুণমান সহ, তিনি একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তি এবং এইভাবে তিনি এমন অনেক কিছু বিকাশ করেছিলেন যা জাতীয় নির্মাণ কার্যক্রমে সহায়তা করেছিল