শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৫
22 C
Dhaka

অর্থনীতির নতুন পরাশক্তি আফগানিস্তান

spot_img

ভিডিও

- Advertisement -

ভিন্ন আর নতুন এক আফগানিস্তান দেখছে বিশ্ব। দুই দশকের যুদ্ধের ফলে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখ থেকে ঘুরে দাড়ানোর গল্প শুনাচ্ছে তারা। অল্প দিনেই আফগানরা অর্থনীতিতে যে সাফল্য দেখাচ্ছে তা অবাক করে দিচ্ছে সবাইকে। এমনকি তাদের সফলতার স্বীকৃতি দিচ্ছে জাতিসংঘসহ খোদ পশ্চিমা বিভিন্ন সংস্থাও। বছরের পর বছর ধরে যে আফগানিস্তানের নাম শুনলেই ভেসে আসতো, যুদ্ধ, সংঘাত, হামলা আর ধ্বংসযজ্ঞের খবর; সেখানে এবার তারা একের পর এক দিচ্ছে সাফল্য আর স্বনির্ভর এক জাতির খবর।  শুন্য হাতে শুরু করে তারা এখন শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার বার্তাই দিচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের কাছে আফগানিস্তানের ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও অর্থনৈতিকভাবে তারা ছাড়েনি। আর্থিকভাবে তালেবানদের পঙ্গু রাখার সব ধরনের চেষ্টাই অব্যাহত রেখেছে ওয়াশিংটন। এমনকি মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে থাকা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের প্রায় দশ বিলিয়ন ডলারও আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি প্রায় সারা বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কারণেও অনেকটা অর্থনৈতিকভাবে একঘরে তালেবান সরকার। কিন্তু এত কিছুর পরও অবিশ্বাস্য ভাবে ঘুরে দাড়াচ্ছে আফগান অর্থনীতি।

আফগানিস্তানকে বদলে দেয়ার সূচনাতে শুধুমাত্র দুর্নীতি বন্ধ করেই পুরো অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে দেশটির ক্ষমতাশীন তালেবান সরকার। যে আফগান রুপির মান ছিল নিন্মমুখি; সেই রুপি এখন রেকর্ড গড়ছে। আফগানিকে বিশ্বের সেরা মুদ্রার খেতাব এনে দিয়েছে। নিজেদের উৎপাদিত পানীয় বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এমনই চমকপ্রত খবর একের পর এক ভেসে আসছে। বন্দুকের যুদ্ধে তালেবানরা জিতলেও অর্থনীতির যুদ্ধে তারা দ্রুতই পরাজিত হবে,  আন্তর্জাতিক মহলের এমন ধারণায় অল্প দিনেই আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে আফগানিস্তান ইসলামী আমিরাত।

২০২৩ সালের শেষের দিকে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়, বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা মুদ্রা আফগানিস্তানের মুদ্রা আফগানি। এমনকি পারফর্মেন্সে শক্তিশালী মার্কিন ডলারকেও ছাড়িয়ে গেছে তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের মুদ্রা। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে তালেবানদের নিয়ে সবসময় নেতিবাচক খবর উপস্থাপিত হলেও তা ঢেকে রাখতে পারেনি তালেবানদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সাফল্যকে। মূলত আফগানিস্তানের ক্ষমতা হাতে নিয়েই প্রায় শূন্য হাতে দেশটির ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে শুরু করে তালেবানরা। গ্রহণ করে এমন সব অর্থনৈতিক নীতি যা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব। এমনকি তালেবানদের নেয়া অপ্রচলিত কিন্তু কার্যকর এসব অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে আধুনিক প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার খুব একটা মিল না থাকলেও দিনশেষে দেখা যাচ্ছে, তালেবানদের প্রণীত নীতি কাজ করতে শুরু করেছে। যার ফলাফলই তাদের মুদ্রা আফগানির শক্তিশালী অবস্থান।

মূলত ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই স্থানীয় লেনদেনে ডলার ও পাকিস্তানি রুপির ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি দেশ থেকে বাইরে ডলার নিয়ে যাওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে তালেবান সরকার। এছাড়া অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য অবৈধ ঘোষণা করে এসব আইন লঙ্ঘনকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দেয় তালেবানরা। একই সাথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির জন্যও নানা উদ্যোগ নেয় দেশটির সরকার। বলা হয়, চার কোটি মানুষের দেশ আফগানিস্তানের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । এসব প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠাতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধু করে তালেবান সরকার। এদিকে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে যে ডলার পাচার হয়, তাতেও আফগান অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার নিলামে তুলে দেশীয় মুদ্রাকে শক্তি জোগাচ্ছে। মুদ্রার ওপর চাপ কমার কারণে ডলার উত্তোলনের সীমাও বাড়িয়েছে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের এসব কার্যক্রমের প্রভাব পড়ে দেশের অভ্যন্তরে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে। ফলে ২০২৩ সালের  শেষ প্রান্তিকে ডলারের বিপরীতে আফগানিস্তানের মুদ্রা আফগানির দর বেড়ে যায় ৯ শতাংশ। আফগানিস্তানের অর্থনীতি ও তার মুদ্রার এই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বীকৃতি মিলছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও। ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে জানায় তারা। এমনকি অর্থনীতির মূল সূচকগুলোতে তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে ইতিবাচক বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অর্থনীতির চাকা সচল করতে বড় অবদান রাখছে কৃষি খাতও। ডালিম বা আনার চাষ আফগানিস্তানের অন্যতম কৃষি। দেশটিতে প্রচুর পরিমাণ ডালিম চাষ হয়; যা উৎপাদন ও রপ্তানিতে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এতদিন সাধারণ ফল হিসেবে ডালিম রপ্তানি হলেও এখন সেটি পানীয় আকারে রপ্তানি হচ্ছে। পামির কোলার শাফা নামের পানীয়টি বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই হইচই ফেলে দিয়েছে। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রয়যোগ্য কোকাকোলার বিকল্প এবং স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে ভাবা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশগুলোতে পামির কোলার চাহিদা এখন তুঙ্গে। বেদানার জুস দিয়ে তৈরি ও কেমিক্যাল বর্জিত এই পানীয়র চাহিদা দ্রুত আরো বেড়েই চলছে। অথচ এই কদিন আগেও বিশ্বে আফিম উৎপাদনে শীর্ষে ছিল আফগানিস্তান। কিন্তু দেশটির বর্তমান তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আফিম উৎপাদনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে আফিমের ফলন প্রায় ৯৫ শতাংশ কমে গেছে বলে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ তারা এখন আফিম ছেড়ে ফল উৎপাদন ও রপ্তানিতে মনযোগী হয়েছে।

তবে আফগানিস্তান আয়তনে যথেষ্ট বড় হলেও এখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম। এ কারণে বরাবরই খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল থাকে দেশটি। যা দেশটির অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। তাই তালেবান ক্ষমতা নিয়েই বুঝতে পেরেছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া খুবই জরুরী। এ লক্ষ্যে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা নিয়েই আফগানিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প কুশটেপা ক্যানেল নামের একটি কৃত্রিম খাল খননের কর্মসূচি হাতে নেয় তালেবান। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়ন ও প্রযুক্তিতে এই খাল নির্মাণ শুরু করে ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ইসলামী আমিরাত। খাল বলা হলেও আসলে ১০৮ মিটার প্রস্থ ও ২৮৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি পুরোদস্তুর নদীই এই কুশটেপা ক্যানাল। এই খালের মাধ্যমে প্রায় ৬ লাখ হেক্টর জমিতে সারা বছর স্থায়ী সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। যা বাস্তবায়ন হলে আফগানিস্তান শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশেই পরিণত হবে না, বরং তারা গম রফতানিকারক দেশেও পরিণত হবে। যা আফগান অর্থনীতির চিত্রই পাল্টে দিতে পারে।

আফগানিস্তানের হাতে নগদ অর্থের স্বল্পতা থাকলেও তাদের হাতে সম্পদের অভাব নেই। দেশটির হাতে যে পরিমাণ লিথিয়াম আছে, তার মূল্য তিন ট্রিলিয়ন বা তিন লাখ কোটি মার্কিন ডলার। কার্যত বৈদ্যুতিক ব্যাটারির মূল উপাদান লিথিয়ামের ওপর ভাসছে পুরো আফগানিস্তান। এছাড়া লৌহ, স্বর্ণের খনি ও অন্যান্য রত্নভাণ্ডার তো রয়েছেই। আর এই সম্পদের কারণে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের অপর পরাশক্তি চীন। পাশাপাশি তুরস্ক সহ অন্যান্য দেশও বসে নেই। তারাও চেষ্টা করছে তালেবান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার।

সব মিলিয়ে আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক চাপ এবং নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবেলা করে যেভাবে একের পর এক সাফল্য অর্জন করছে, তা বিশ্ববাসীর জন্য যেমন চমক, তেমনি অনেকের কাছে গবেষণারও বিষয় হয়ে উঠছে। অনেকেই বলছেন, স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারলে এক দশকেরও কম সময়ে দেশটির অর্থনীতি এতটাই মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যাবে, যা অনেক দেশের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠবে।

- Advertisement -
spot_img

আলোচিত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ

ভিডিও