২০১২ সালে পুরোদস্তুর অভিনেত্রী হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেন বলিউডের প্রভাবশালী নির্মাতা এবং প্রযোজক মহেশ ভাট কন্যা আলিয়া ভাট। নেপোটিজমের নানা সমালোচনা এবং নেগেটিভিটি একদিকে সরিয়ে কাজের মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারের এক যুগ পার করা আলিয়া ভাট এই সময়ে বলিউডের অন্যতম সেরা জনপ্রিয়, দক্ষ এবং সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া একজন অভিনেত্রীদের একজন। নাম, যশ, খ্যাতির সাথে সাথে অসাধারণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও জয় করে নিয়েছেন তিনি।
বলিউডের প্রায় সব প্রথম সারির পরিচালক প্রযোজকদের মতে আলিয়া আগামী দিনের বলিউডের সবচেয়ে বড় তারকা অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছেন। যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এখনই। একটা সময় নেপোকিড ট্যাগ লাগানো এই বলিউড তারকা নিজের অভিনয় প্রতিভার জোরে সেই ভবিষ্যৎবানী সত্য করার পথে নিজেকে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। তার জেনারেশনের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যেকয়জন অভিনেত্রী আছে তার মধ্যে তিনি অনন্য। বলা হয়ে থাকে, বলিউডের নেক্সট লেডি সুপারস্টার তিনিই।
শুধুমাত্র সৌন্দর্য্য বা পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের জোরে নয় আলিয়া তার অভিনয় দক্ষতা এবং ভিন্নধর্মী সিনেমা, শক্তিশালী চরিত্র নির্বাচন দিয়ে নিজেকে দিন দিন নিয়ে যাচ্ছেন এক অন্যন্য উচ্চতায়। আলিয়ার শুরুটা নিজেদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বলিউডের সুপ্রতিষ্ঠিত ভাট ফিল্মসের মাধ্যমে নয়। বলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজক এবং পরিচালক করন জোহর এবং বলিউড কিং শাহরুখ খানের প্রযোজনায় ‘স্টুডেন্ট অব দ্যা ইয়ার’ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন আলিয়া। করন জোহরের পরিচালনায় বরুন ধাওয়ান এবং সিদ্ধার্থ মালহোত্রার সাথে জুটি বেধে প্রথম সিনেমা সুপারহিট। সাথে নিজের সৌন্দর্য্য এবং অভিনয় দক্ষতার ঝলক,এবং নৃত্য পারদর্শীতা দিয়ে নজর কাড়েন তিনি। ফলাফল সেই বছর সেরা নবাগতার সকল পুরস্কার তার ঝুলিতে আসে।
দ্বিতীয় সিনেমা বলিউডের অন্যতম সেরা পরিচালক ইমতিয়াজ আলীর ‘হাইওয়ে’। প্রথম সিনেমার ধনীর আদুরে দুলালী, ডিজাইনার ড্রেস, রোমান্টিক নায়িকার ইমেজ থেকে বেরিয়ে ‘হাইওয়ে’ সিনেমায় পুরোপুরি এক অন্য চরিত্রে দেখা দেন তিনি। মেকাপ ছাড়াই স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত একটি কিশোরীর চরিত্রে ভাটের অভিনয় চলচ্চিত্র সমালোচকদের নিকট ইতিবাচক মন্তব্য লাভ করেন তিনি। তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য ফিল্মফেয়ার সমালোচক পুরস্কার জিতে নেন।
প্রথমে স্টারকিড হিসেবে নেগেটিভ মন্তব্য করলেও বলিউডের সমালোচক এবং সাধারন দর্শকেরা নড়েচড়ে বসেন এবার। অভিনেত্রী হিসেবে আলিয়া যে পরিপক্ক এবং তিনি রাজত্ব করতে এসেছেন বলিউডে তা প্রমান করেন এই সিনেমার মধ্য দিয়েই। এরপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার। ‘টু স্টেটস’, ‘বদ্রিনাথ কি দুলহানিয়া’, ‘হাম্পটি শর্মা কি দুলহানিয়া’, ‘কাপুর এন্ড সন্স’ আলিয়া বক্স অফিসে নির্ভরযোগ্য দক্ষ তারকা অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমান করেন। মাঝে ‘শানদার’ সিনেমায় অভিনয় করে সমালোচিত হলেও তারপরেই ‘ডিয়ার জিন্দেগী’ সিনেমায় এই যুগের এক স্বাধীনচেতা নারী যে নিজের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে জীবন-যাপন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা একজন মানুষ এবং ‘উড়তা পাঞ্জাব’ সিনেমায় এক আদিবাসী ভারতীয় কিশোরীর চরিত্রে অভিনয় করে বলিউডের এই প্রজন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার এবং জনপ্রিয়তা সবই লাভ করেন তিনি।
২০১৮ সালে মেঘনা গুলজারের ‘রাজি’ সিনেমায় ‘শেহমত’ নামের এক গুপ্তচরের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় একজন এজেন্ট হিসেবে পাকিস্তানি এক সেনা অফিসারকে বিয়ে করে পাকিস্তানে চলে যাওয়া এবং সেখান থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভারতে পাঠানো এক গুপ্তচর হিসেবে তিনি এককথায় স্তব্ধ করে দিয়েছেন আলিয়া। নারী কেন্দ্রিক এই সিনেমা বক্স অফিসে ১০০ কোটির ক্লাবে জায়গা করে নেয়। একা নিজের কাধে ভর করেই এই সিনেমা টেনে নিয়েছেন তিনি। অভিনেত্রী হিসেবে তার এই চরিত্র বলিউডের এই প্রজন্ম তো বটেই নারীপ্রধান যেকয়টি সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা একটি কাজ বলে বিবেচিত হয়।
২০১৯ সালে জয়া আখতারের ‘গাল্লি বয়’ সিনেমায় রনভীর সিংহের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেন তিনি। স্বল্প সময়ের জন্য তাকে এই সিনেমায় দেখা গেলেও তার লুক, ড্রেস আপ, চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়া এবং ডায়লগ ডেলিভারি তাকে এনে দিয়েছে প্রশংসা এবং খ্যাতি। তবে এই সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে বির্তকের সূচনাও হয়েছিলো।
তবে তারকাদের সব সময় এক রকম যায়না এটাও ধ্রুব সত্য। বলিউডে প্রতি শুক্রবার সমীকরন বদলায়৷ ধর্মা প্রোডাকশনের বিগ বাজেটের মাল্টিস্টারার ‘কলঙ্ক’ সিনেমা বক্স অফিস ডিজাস্টার হিসেবে গন্য হলেও মাধুরী, সঞ্জয়, বরুন, সোনাক্ষী, আদিত্য এর মতো তারকাদের মাঝেও নিজের অস্তিত্ব বেশ ভালোভাবেই দেখিয়েছেন আলিয়া। বিশেষ করে ‘ঘর মোরে পারদেশিয়া’ গানে তার ক্ল্যাসিক ঘরানার নৃত্য পারদর্শীতা মুগ্ধ করেছে সবাইকে। ২০২০ সালে সুশান্ত সিং রাজপুত এর মৃত্যুর পর পুরো বলিউড যখন নেপোটিজম ইস্যুতে বিভক্ত এবং সাধারণ দর্শকদের এই ইস্যু বিভক্তিতে ফেলে তখন যে কয়জন তারকার দিকে আঙুল উঠেছিলো স্টারকিড হিসেবে সুবিধা পাওয়ার তালিকায় সেখানে তার নামও ছিলো। হয়তো সেই রেশ ধরেই বাবা মহেশ ভাটের পরিচালনায় ‘সড়ক ২’ সিনেমা ওটিটিতে রিলিজ দেয়া হলেও দর্শক গ্রহন করেননি।
তবে আলিয়া ভাট নীরব থেকেছেন প্রতিটা সময়। কারন তিনি জানতেন একমাত্র তার কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং পরিশ্রম একটা সময় এসব প্রশ্নের সমুচিত জবাব দিবে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হয়েছেও তাই। সঞ্জয় লীলা বানসালীর পরিচালনায় ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি’ সিনেমায় তার লুক, দক্ষ অভিনয়ের ঝলক এবং শক্তিশালী ডায়লগ ডেলিভারি তার কঠোর সমালোচকেও আলিয়ার সুনাম করতে বাধ্য করেছে। তারকাদের পাশাপাশি সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। এই সিনেমা মুক্তি পাবার পর অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রশংসার পাশাপাশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করেছেন এই সিনেমা দিয়ে।
অয়ন মূখ্যার্জির পরিচালনায় সাই-ফাই ফ্যান্টাসি সিনেমা ‘ব্রক্ষ্মাস্ত্র’তেও রনবীর কাপুর, অমিতাভ বচ্চন এর পাশে উজ্জ্বল ছিলেন আলিয়া। দক্ষিণের ‘বাহুবলী’খ্যাত নির্মাতা এস. এস. রাজামৌলির ‘আর আর আর’ বা ‘ট্রিপল আর’ সিনেমায় স্বল্প সময়ে তিনি নজর কেড়েছেন। ‘সীতা’ নামক একটি চল্লিশ দশকের দক্ষিন ভারতীয় নারী চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। বলিউডের আরো অনেক তারকার মতো ওটিটি বা ডিজিটাল মাধ্যমেও ডেবিউ করছেন আলিয়া ভাট। জসমীত কেরিন পরিচালিত সিনেমা ‘ডার্লিংস’ এ অনবদ্য অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজক হিসেবেও ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়ে পা রেখেছেন আলিয়া ভাট। সর্বশেষ করণ জোহরের ফুল মাসালা এন্টারটেইনমেন্ট সিনেমা ‘রকি অউর রানী কি প্রেম কাহানী’তেও বাংগালী এক স্বাধীন চেতা এবং মুক্তমনা এই সময়ের তরুনী রানী’র চরিত্রে তার অভিনয় দক্ষতা আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে তরুন প্রজন্মের কাছে এই সময়ে আলিয়ার ক্রেজ অন্য লেভেলের।
সব মিলিয়ে বলা যায় ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটাচ্ছেন ভাট কন্যা। আলিয়া ভাট ১৯৯৩ সালের ১৫ মার্চ ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। অভিনেত্রী হবার শখটা ছিল ছোটবেলা থেকেই। তাই নিজেকে তৈরী করেছেন সেভাবেই। নাচ শিখেছেন, ফিটনেসে মনোযোগী হয়েছেন। অভিনয়ের নানা কর্মশালায় যোগদানের পাশাপাশি এক্টিং স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। আবৃত্তি এবং বই পড়া তার অন্যতম শখ। বলিউডের একজন শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এখনো প্রতিনিয়ত চেস্টা বা এক্সপেরিমেন্ট করতে কোনো ক্লান্তি বা বিরতি নেই তার।
কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে আলিয়া বলেন, ‘বলিউডই এখন আমার ধ্যান-জ্ঞান। অনেকেই বলেন আমি ভালো অভিনয় করতে পারি, কিন্তু আমার মনে হয় আমার শেখার এখনো অনেক কিছুই বাকি। আমি প্রতিদিনই নতুন নতুন কিছু শিখছি। ভবিষ্যতে আমি যেন বলতে পারি, আমি একজন ভার্সেটাইল অভিনেত্রী, সব ধরনের চরিত্রে আমি অভিনয় করতে পারি। এই কনফিডেন্স নিজের মধ্যে আনার জন্য চেস্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত”।
সম্প্রতি তিনি আলোচনায় এসেছেন মেটগালা-২০২৪ এ প্রখ্যাত ডিজাইনার সব্যসাচী’র ডিজাইন করা অসাধারণ সুন্দর ফ্লাওয়ার প্রিন্টের শাড়িতে উপস্থিত হবার কারনে। যেখানে এই রকম আয়োজনে বরাবরই হলিউড বা বলিউড তারকারা কিছুটা ভিন্নরকম এবং অদ্ভুত সাজসজ্জা নিয়ে হাজির হন সেখানে আলিয়ার ভারতীয় সংস্কৃতির রীতি অনুযায়ী শাড়ি এবং গয়নায় হাজির হওয়াটা প্রশংসা পাচ্ছে সকলের।
খ্যাতি এবং সফলতার শিখরে থাকা অবস্থায় তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেন বলিউডের আরেক তারকা রনবীর কাপুরকে। বিয়ের পরে কন্যা সন্তানের মা হিসেবে শুরু করেছেন জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়। অন-স্ক্রিনের পাশাপাশি অফ-স্ক্রিনেও আলিয়া ভাট পার করছেন জীবনের সেরা সময়। নিজের বুদ্ধিমত্তা, অভিনয় প্রতিভা, সৌন্দর্য্য এবং ব্যক্তিত্ব তাকে নিয়ে যাবে আরো উচ্চতায় এমনটাই আশা তার ভক্তদের।