এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন এই প্রবাদটি তার ক্ষেত্রে মিলে যায় পুরোপুরি। শুধু যে প্রবাদটি মিলে গেলো তেমন নয়, বরং সেই প্রবাদটি এখনো সাফল্যের সাথেই ধরে রেখেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম কিংবদন্তি এই লাস্যময়ী অভিনেত্রী। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সফল এবং সুঅভিনেত্রী হিসেবে জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা পাবার পাশাপাশি তার সৌন্দর্য এবং মিষ্টি হাসিতে কত কিশোর এবং যুবকের রাতের ঘুম নষ্ট হয়েছে সেটা হিসেব করে বলা যাবে না। যার কথা লেখা হচ্ছে তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মৌসুমী।
১৯৭৩ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করা চলচ্চিত্রের প্রিয়দর্শিনী খ্যাত মৌসুমী দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরেই আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাজ করে গেছেন। ক্যালেন্ডারের হিসাবে পঞ্চাশ বছর পার করলেও আজো তার মায়াবী হাসি, অসাধারণ সৌন্দর্য, আর মোহনীয় চাহনীতে বুঁদ হয়ে আছেন একটা পুরো প্রজন্ম। প্রায় তিন দশক আগে যে মুগ্ধতার রেশ তিনি ছড়িয়েছিলেন তা অটুট এখনো। অনেকের মতে মৌসুমীর মতো আক্ষরিক অর্থে স্টারডম পাওয়া এবং সেটা ধরে রেখে কাজ করে যাওয়া অভিনেত্রীর সংখ্যা আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে হাতেগোনা। কবরী, শাবানা, ববিতার পরেই নব্বইয়ের দশকের দুই কিংবদন্তি অভিনেত্রী হিসেবে মৌসুমী এবং শাবনূরের স্থান।
১৯৯৩ সালে ঢাকাই চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা তৈরি হয়েছিল ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ এর মাধ্যমে। সেই ব্যবসাসফল এবং প্রশংসিত সিনেমায় রেশমী রূপে যে সফল এবং রাজসিক যাত্রা শুরু করেছিলেন প্রিয়দর্শনী মৌসুমী ৩০ বছর পেরিয়ে এসে তা এখনো চলমান। মৌসুমীর মতো সৌন্দর্য, লাস্যময়ী হাসি, ফ্যাশন সেন্স, অভিনয় দক্ষতা সব মিলিয়ে নায়িকা হিসেবে একটি কমপ্লিট প্যাকেজ এমনটা ঢাকাই সিনেমায় হাতেগোনা কয়েকজন অভিনেত্রীর মধ্যেই পাওয়া যায়। বৈচিত্র্যময় এক লম্বা ক্যারিয়ারের সাথে সাথে ব্যক্তিজীবনেও সফল এক অধ্যায় পার করেছেন তিনি।
মৌসুমী প্রথম নায়ক সালমান শাহের সাথে তার জুটি ছিল প্রশংসিত এবং জনপ্রিয়। তবে পরবর্তীতে ওমর সানীর সাথে আরেকটি সফল জুটি গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি ইলিয়াস কাঞ্চন, আমিন খান, শাকিল খান, রুবেলের সাথেও অনেক ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। তবে মান্না-মৌসুমী জুটিও ঢাকাই চলচ্চিত্রের একটি জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত অধ্যায়। রিয়াজ, ফেরদৌস এবং শাকিব খানের সাথেও বক্স অফিসে সফল সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা গেছে তাকে। গল্পের ডিমান্ড এবং বয়সের সাথে মানানসই চরিত্রে তিনি হুমায়ুন ফরীদি, আহমেদ রুবেল বা ফজলুর রহমান বাবুর সাথেও জুটি বেধে কাজ করেছেন ভিন্নধর্মী সিনেমায়।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন তার ক্যারিয়ারের পিক টাইমে। আফজাল হোসেন, মাহফুজ আহমেদ, তৌকির আহমেদ, জাহিদ হাসানের সাথে মৌসুমীর স্ক্রিন জুটি আলোচনা এবং প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। সিনেমায় প্রচন্ড ব্যস্ততার পাশাপাশি একই সাথে টেলিভিশনের নানা টেলিফিল্ম এবং নাটকে দেখা গেছে মৌসুমীকে। একই সাথে বিজ্ঞাপনেও তিনি অনবদ্য পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন। বিশ্বখ্যাত ‘লাক্স’ সাবানের মডেল হয়েছেন অসংখ্যবার। এর বাইরেও অসংখ্য জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছেন মৌসুমী। কোনো প্রজেক্টে মৌসুমীর উপস্থিতি মানেই যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করা সেটা ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে।
মিডিয়াতে তারকাদের বিচ্ছেদ যেখানে হরহামেশাই দেখা যায় সেখানে হাতেগোনা অল্পকিছু জুটি সুখে শান্তিতে সংসার করছেন সেই লিষ্টের অন্যতম সফল এবং আইকনিক নাম মৌসুমী-ওমর সানি। কিছুদিন আগে তাদের সাংসারিক জীবন নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা গেলেও ১৯৯৬ সালে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এই অভিনেত্রী স্বামী ওমর সানি, দুই সন্তান এবং পুত্রবধূকে নিয়ে সুখেই সংসার করছেন। কিছুদিন আগে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে শ্বাশুড়িও হয়েছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনেও তিনি এখনো জনপ্রিয় এক নাম। ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেছেন। প্রযোজক, পরিচালক, গায়িকা, সমাজসেবী হিসেবে নিজের নাম সফলতার সাথেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন মৌসুমী।
২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ সিনেমা পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। এরপরে ’মেহের নেগার’ চলচ্চিত্রটিও পরিচালনা করেন তিনি। পাশপাশি তার প্রোডাকশন হাউজ থেকে তিনটি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন। সিনিয়র রাজ্জাক, আলমগীর, কবরী, শাবানা, ববিতা, সুবর্ণা মুস্তফার মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের সাথে কাজ করেছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে সুবর্ণা মুস্তফার মতো নান্দনিক অভিনেত্রী মৌসুমী সম্পর্কে বলেছেন- নায়িকা বা স্টার বলতে যা বোঝায় সেটার একেবারে জলজ্যান্ত উদাহরণ মৌসুমী। তার ব্যক্তিত্ব, স্টার ইমেজ ধারন করার ক্যাপাবিলিটি সব কিছু মিলিয়ে তিনি একজন পরিপূর্ণ নায়িকা।
প্রায় ২৫০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করা তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী মৌসুমী সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ভিন্নধর্মী সিনেমায় অভিনয় করেছেন যা হয়তো অভিনেত্রী হিসেবে তাকে আরো পরিপক্ক এবং নন্দিত জায়গায় নিয়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বয়সের সাথে মানানসই কিন্তু ব্যতিক্রমী চরিত্রে পছন্দের অভিনেত্রীকে দেখার সুযোগ মিলবে এটাই তার ভক্তদের কামনা। এর মধ্যে আশুতোষ সুজনের ‘দেশান্তর’ সিনেমাতে অন্নপূর্ণা চরিত্রে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন নির্মিত ‘ভাঙন’ নামের সিনেমার দেশের অন্যতম শক্তিশালী এবং নন্দিত অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবুর সাথেও পাল্লা মিলিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। গত ঈদে সানী-মৌসুমী দম্পতিকে দেখা যায় ‘সোনার চর’ সিনেমায়। এর বাইরে জাহিদ হোসেনের পরিচালনায় ‘ছিটমহল’ ও ‘কানাগলি’ নামে আরও দুটি সিনেমার কাজ শেষ হয়েছে। এসব সিনেমা রিলিজ পেলে হয়তো ব্যতিক্রমী দুটি সিনেমায় দেখতে পাবো আমাদের প্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমীকে।
তবে একই সাথে আক্ষেপ এবং দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সময় পরে অভিনেত্রীদের নিয়ে সেভাবে গল্প বা চরিত্র লেখা হয় না। যার কারণে চরিত্রে ডাইমেনশন আছে বা বয়সের সাথে মানানসই চরিত্রে অভিনেত্রীদের সেভাবে আমরা পাই না। হলিউড বা বলিউডের কথা বাদ দিলে কলকাতার সিনেমাতেও অভিনেত্রীরা যেভাবে বয়সের সাথে মানানসই চরিত্রে এখনো কাজ করার সুযোগ পান সেটা আমাদের দেশের মৌসুমী, শাবনূর বা পূর্ণিমারা পাচ্ছেন না।
মৌসুমীর ক্যারিয়ারের আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো যেটা হলো- তার সমসাময়িক বেশিরভাগ অভিনেতা এবং অভিনেত্রীরা অভিনয় থেকে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে আছেন আবার কেউ রূপালী জগত থেকে বিদায় নিয়েছেন অনেক আগেই। তবে মৌসুমী এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন যদিও সংখ্যাটা কম, তবুও বয়স এবং সময়ের সাথে মানানসই চরিত্রে ইদানীং তাকে দেখা যাচ্ছে এটা তার ভক্তদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। যদিও সম্প্রতি শাবনূর ফিরেছেন নতুন করে যা তার ভক্তদের মাঝে চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। যদিও বছরখানেক হলো অভিনয় থেকে কিছুটা দূরেই আছেন মৌসুমী, তবুও তার ভক্তদের আশা তিনি শিগগিরই ফিরবেন আবারো রূপালী পর্দায়।
সবমিলিয়ে বলা যায় সিনেমা, বিজ্ঞাপন এবং পাশাপাশি সেবামূলক কার্যক্রমে নিজেকে ব্যস্ত রাখা এই অভিনেত্রী সামনের দিনেও ব্যতিক্রমী চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং মনোমুগ্ধকর স্ক্রিন প্রেজেন্স দিয়ে এভাবেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাবেন এটাই কামনা।