বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪
28 C
Dhaka

ঐতিহাসিক ২৬ মার্চঃ মহান স্বাধীনতার ঘোষণা ও  বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার

আরো পড়ুন

- Advertisement -

ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ইতিহাসের এই দিন বাঙালির শৃঙ্খল মুক্তির দিন, বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি।

 

একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত্রির পোড়া কাঠ, লাশ আর জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ভীত বিহ্বল মানুষ দেখল লাশপোড়া ভোর, সাথে সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ। স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সবুজ পতাকা যখন পুড়ে ছাই তখন মুক্তিকামী মানুষ পেল প্রতিরোধ গড়ে তোলার নতুন নির্দেশনা। ২৫ মার্চের দিবাগত রাত দেড়টায় গ্রেফতারের পূর্বে মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন দেশের স্বাধীনতা। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন।

 

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমান (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেনাদের নিয়ে বিদ্রোহ করেন। পাকিস্তানি ও অবাঙালিদের বন্দী করে রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।(১)

 

চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-পুলিশ-ইপিআর ও বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী নগরীর কয়েকটি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। রাতে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সেনারা মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এদিকে, সকালে রংপুর থেকে এসে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়া শহর আক্রমণ করে।  কালীতলাহাট পার হওয়ার পর কিছু প্রতিরোধযোদ্ধা এসে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করে। বড়গোলায় তারা কঠিন প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তুমুল প্রতিরোধের মুখে দুপুরে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে শহর ছেড়ে এক ডাকবাংলো ও মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। সেদিন ঝাউতলায় যুদ্ধে শহীদ হন আজাদ নামে এক প্রতিরোধযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে বগুড়ার মাটিতে আজাদই প্রথম শহীদ। এদিনের যুদ্ধে আরও তিনজন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন।(২)

 

এদিকে, রাত আটটায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচি থেকে বেতার ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে আবার সরকারের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন। তিনি ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ তিন সপ্তাহ ধরে আইনসংগত কর্তৃপক্ষকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করে সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছেন। তাঁরা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন, পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ও জাতির জনকের ছবির অবমাননা করেছেন এবং আইন অমান্য করে সমান্তরাল সরকার গঠনের প্রয়াস চালিয়েছেন। ইয়াহিয়া খান হুশিয়ার করে বলেন, শেখ মুজিব দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছেন। এর শাস্তি তাঁকে অবশ্যই পেতে হবে। ইয়াহিয়া খান আরও জানান, সেনাবাহিনীকে তিনি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সারা দেশে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। সেদিন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রচারমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপও বলবৎ করা হয়।(৩)

 

২৬ মার্চ সারা দিন ও রাতে সান্ধ্য আইন জারি করে পাকিস্তানি সেনারা দলে দলে রাস্তায় নেমে ভবন, বস্তি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি আক্রমণ করে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ২৬ মার্চ দিনরাত হাজার হাজার লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়ে পাকিস্তানি সেনারা শত শত লাশ মাটি চাপা দেয়। পুরান ঢাকার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গা নদীতে। সেদিন বিদেশি সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রাখা হয়। তাঁদের বাইরে আসতে দেওয়া হয়নি। আর পাকিস্তানি সেনারা ট্যাঙ্কের গোলায় ধ্বংস করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং কয়েকটি পত্রিকা অফিস । নিউইয়র্ক টাইমস–এর ২৮ মার্চ সংখ্যায় জানা যায়, দ্য পিপল অফিস পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে সাংবাদিকেরা এ দৃশ্য দেখেছেন।(৪)

 

সেদিন শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বেতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে গোপনে সম্প্রচারে আসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ কেন্দ্র থেকেই ২৬ মার্চ বেলা ২টা ১০ মিনিট এবং ২টা ৩০ মিনিটে এম এ হান্নান স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।(৫) আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার এই নেতা ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে নিজ নামে এ ঘোষণা পাঠ করেন। এরপর রাত ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন স্টেশন থেকে আবার বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথমে বাংলায় এবং পরে ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে ঘোষণাটি পাঠ করা হয় । রাত ১০টায় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ইংরেজিতে একটি আবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার এবং মুক্তিকামী জনগণকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়।

 

পরদিন চট্টগ্রামের কালুরঘাট কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চের মতোই দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নামে যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি তিনি পাঠ করেন, সেটি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ডে সংরক্ষণ করা হয়েছে।(৬) ওই ঘোষণা চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা একটি জাপানি জাহাজ প্রথম শুনতে পেলে তাৎক্ষণিকভাবেই তারা সেটি সারা বিশ্বের কাছে প্রচার করে দেয়। এটি প্রথম সম্প্রচার করে রেডিও অস্ট্রেলিয়া এবং এর ফলে বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা বিস্তারিত জানতে পারে। আর এভাবেই শুরু হয় বাঙালির অনুষ্ঠানিক প্রতিরোধ যুদ্ধ। ফলস্বরূপ দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।

 

তথ্যসূত্রঃ

(১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর এক, পৃষ্ঠা-৬০-৬১

(২) বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র’-এর নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮৩ ও ৪৮৪

(৩) পাকিস্তান অবজারভার, ২৭ মার্চ ১৯৭১

(৪) দ্যা টেলিগ্রাফ , ৩০ মার্চ ১৯৭১

(৫) একাত্তরের দিনপঞ্জি- মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, পৃষ্ঠা-৫৯/ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র’-এর পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৮৩ ও ১৯১

(৬) একাত্তরের দিনপঞ্জি- মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, পৃষ্ঠা-৬২

আলোচিত

কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Click to Call Call Now

সর্বশেষ