বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪
28 C
Dhaka

ওয়ার ইকোনমি: যুদ্ধকালীন অর্থনীতির বাস্তবতা

আরো পড়ুন

- Advertisement -

দুটি ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে বিশ্বে। একটি হামাস আর ইজরায়েলের মধ্যে আরেকটি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে। চলমান এসব যুদ্ধ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে-যুদ্ধ কতটা নির্মম আর ভয়াবহ। যুদ্ধ মানেই যে ধ্বংসলীলা; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আবারো তা নির্মম ভাবে উপলব্দি করছি আমরা। দেখছি, কিভাবে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে নিরিহ মানুষ আর অসহায় নারী শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। মানবতা কিংবা আন্তর্জাতিক আইনের বুলি যতই আওড়ানো হোক না কেন, দিনশেষে যুদ্ধ শুরু হলে এসব বেমালুম ভুলে যায় কোন কোন পক্ষ। তারপরও বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা ইস্যুতে যুদ্ধের দামামার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তবে প্রতিটি যুদ্ধই শুধু অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়; সাথে থাকে অর্থনীতির করুন আর ভয়াবহ বাস্তবতা।

যেকোনো যুদ্ধের সময়ই বিবাদমান দেশগুলোর অর্থনীতিতে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। গতানুগতিক সময়ে যেভাবে অর্থনীতি পরিচালিত হয়, যুদ্ধের সময়ও যদি সেভাবেই পরিচালিত হতে থাকে, তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য। আবার যদি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে বুঝে যথাযথ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হওয়া যায়, তাহলে যুদ্ধে জয়লাভ তো বটেই; অর্থনৈতিকভাবেও বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব। স্বাভাবিকভাবে যদি যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে দেশগুলোর সরকারকে অন্যান্য খাতের চেয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্মাণ খাতে বেশি বিনিয়োগ করতে হয়। মূলত যুদ্ধের সময় যে বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, সেটিই হচ্ছে ‘ওয়ার ইকোনমি’ বা যুদ্ধকালীন অর্থনীতি।

প্রতিটি রাষ্ট্রই যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্র মজুদ করে রাখে। কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রয়োজন হয়। এরকম পরিস্থিতিতে অবশ্যই পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নতুন করে সরবরাহ করতে হবে, সামরিক যানবাহনের নতুন বহর পাঠাতে হবে এবং যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পুনরুৎপাদন করে রণক্ষেত্রে প্রেরণ করতে হবে। সুতরাং, যুদ্ধক্ষেত্রে সরবরাহের জন্য সেই দেশের সরকারের হাতে যদি পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে, তাহলে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যুদ্ধের সময় অন্যান্য খাতের ব্যয় কমিয়ে যুদ্ধাস্ত্র, যানবাহন, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্মাণের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় কারা হয়।

যুদ্ধের সময় যে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেটি সংগ্রহের জন্য সরকার বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি হচ্ছে করের হার বাড়িয়ে দেয়া। জনগনের উপর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে বিশাল পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব হয়, যেটি যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যয় মেটাতে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া অনেক সময় ‘ওয়ার বন্ড’ ছাড়া হয়, যার মাধ্যমে জনগণকে বাড়তি আয়ের সুযোগ দিয়ে সরকার কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। তবে এসব ছাড়াও নানা পদ্ধতি ও কৌশলে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক সময় মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ঋণও নেয়া হয়।

যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্য ও যুদ্ধের সাথে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিশাল চাহিদা তৈরি হয়। যদি লড়াই করতে করতে অস্ত্র শেষ হয়ে যায়, তাহলে পশ্চাদপসরণ করে টিকে থাকা সম্ভব। কিন্তু যদি খাদ্য শেষ হয়ে যায়, তাহলে কোনোভাবেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। এজন্য যুদ্ধের সময় সৈন্যদের খাবারের কোনো সংকট যেন দেখা না দেয়, সরকারকে এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। যদি কোনো দেশের কৃষিখাত শক্তিশালী থাকে, তাহলে খাবারের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হয় না। এর পাশাপাশি উন্নত শিল্পকারখানাগুলো কাজে লাগিয়ে অনায়াসে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা যায়। এরপরও যদি ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বাইরের দেশ থেকে খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সর্বপরি সরকারকে সদা খেয়াল রাখতে হয়, দেশের মানুষের খাবারে যেন কোন ঘাটতি তৈরি না হয়। এমনটি হলে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে নিজ দেশেই।

যুদ্ধের সময় যখন রণক্ষেত্রের প্রয়োজনে প্রায়শই বাড়তি সৈন্যের প্রয়োজন হয়, তখন সেই চাহিদা মেটাতে সরকার সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সৈন্য তো বটেই, এর পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর মানুষকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রণক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়। এতে বিভিন্ন পেশায় কর্মক্ষম জনগণের শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতা পূরণের জন্য সরকার সাধারণত নারী ও বেকার জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়। এভাবে যুদ্ধের সময় বিভিন্ন পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে নারীরা স্বাবলম্বী ও দক্ষ হয়ে ওঠে। যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যুদ্ধের সময় যেসব দেশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখে, তাদের অর্থনীতিতেও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। কারণ যুদ্ধে বিবাদমান দেশগুলোর অনেক কিছু আমদানি করার প্রয়োজন হয়। সুতরাং, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা দেশগুলো যদি চাহিদামতো বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করতে পারে, তাহলে বেশ বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার সম্ভাবনা থাকে। তাই সঠিক সামরিক পরিকল্পনা থাকলে ‘ওয়ার ইকোনমি’র মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও অর্জন করা সম্ভব। বিশ্ব মোড়লরা অনেক সময় সেই অর্থনীতির লোভেই নিরীহ মানুষের প্রাণ আর রক্ত নিয়ে খেলা করে।

আলোচিত

কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Click to Call Call Now

সর্বশেষ