টাকার আবার ভাল-মন্দ কী? আচ্ছা, টাকার কী কোনো রঙ আছে? তাহলে কালো টাকা সাদা টাকার প্রশ্ন উঠছে কেন? কারাই বা কালো টাকার মালিক? কীভাবে তৈরি হচ্ছে কালো টাকা? আপনি জানেন কী, আপনার টাকা সাদা নাকি কালো? টাকার রঙ না থাকলে কালো টাকা সাদা করার প্রশ্নে এত হইচই কেন? এমন অনেক প্রশ্নই ঘুরেফিরে দোলা দিচ্ছে মনের অজান্তে। এক কথায় উত্তর দেয়া যায়, টাকার কোনো রঙ নেই। আপনার হাতে টাকা থাকলেই যেকোনো কিছু করতে পারবেন অনায়াসে। শুধু প্রশ্ন বৈধতা নিয়ে। যে অর্থকড়ি বা টাকা আপনি উপার্জন করছেন সেটির উৎস যথার্থ না হলেই বিপত্তি। অজানা উৎস থেকে দুর্নীতির উপায়ে অবৈধ অর্থই কালো টাকা। অনেকে কালো টাকার বিকল্প শব্দ হিসেবে এই টাকাকে অপ্রদর্শিত অর্থ বলে থাকেন। তবে, সবসময় যে সব কালো টাকাই অবৈধ পন্থা বা দুর্নীতির মাধ্যমে আয় হয় বিষয়টি তেমন নয়।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা তৈরি হয়। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দাম কম বা বেশি দেখিয়ে শুল্ক-কর কমিয়ে দেখানো হয়। এর মাধ্যমে যে অর্থ কৌশলে সরিয়ে নেয়া হয় বা পাচার করা হয় সেটাই কালো টাকা। আবার ধরুন, দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকাও কালো টাকা। ইদানিং একটি নাম বেশ উচ্চারিত। আলোচিত সেই সাবেক পুলিশ প্রধান বা আইজিপি বেনজির আহমেদের অঢেল সম্পদের সন্ধান মিলেছে। অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা তার যে বিলাসবহুল রিসোর্ট, বাংলোবাড়ি বা শত শত বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া গেছে সেসবের বেশিরভাগই অবৈধ টাকায় গড়া। কারণ তার পৈত্রিক সম্পত্তি বা কর্মজীবনের বেতন-ভাতা দিয়ে রাতারাতি এত সম্পদ গড়া সম্ভব নয়। তাহলে নিজের আয়ের উৎসের বাইরে যে সম্পদ তিনি গড়েছেন তার সবই কালো টাকা। আরেকটা সহজ উদাহরণ দেই। ধরুণ একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারির মাস শেষে বেতন পান ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু মাসে উপরি আয় করেন বা ঘুষ নেন আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা। এ বাড়তি অর্থ যার হিসাব আয়কর বিবরণীতে তিনি দেখান না সেটাই কালো টাকা। আবার ধরুন, আপনি তিন কাঠা জমি কিনলেন বা বিক্রি করলেন এক লাখ টাকা দরে তিন লাখ টাকায়। কিন্তু জমির দলিলে দেখানো হলো ৩০ হাজার টাকা কাঠা। কারণ আপনি চাইলেও জমির দাম মৌজাভেদে এর কম বা বেশি দাম দেখাতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে নির্ধারিত দামে জমি রেজিস্ট্রি করলেন। এই যে বাড়তি দাম পেলেন, কিন্তু দেখালেন কম। বাকী অর্থই কালো টাকা। যদিও অনেকে এ অর্থকে অপ্রদর্শিত অর্থ বলে থাকেন। এর বাইরে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ফাইল আটকে নেয়া ঘুষ, নির্ধারিত আয়ের বাইরে উপরি ইনকাম, কাজ করে দেয়ার নামে ‘আন্ডার টেবিল ডিল’ বা অবৈধ উপরিঢৌকনের মতো যত ইনকাম আছে সবই কালো টাকা। সরকারি নথিপত্রের ভাষায় আয়কর বিবরণীতে দেখানো যায়নি বা কর দেয়া হয়নি এমন টাকাই কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ। সত্যিকার অর্থে হিসাব করলে দেখা যাবে শুধু বড় রাঘববোয়ালরা নয়, আমাদের সমাজে ছোট-বড় অনেক চুনোপুঁটি কর্মচারিও কালো টাকার মালিক। ২৫/৩০ হাজার টাকা বেতন পেয়েও ৪০/৫০ হাজার টাকার ভাড়া বাসা বা কোটি টাকায় কেনা নিজের ফ্ল্যাটে থাকা লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াসহ অন্য খরচের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। এদের অনেকে কালো টাকার মালিক।
কালো টাকা নিয়ে হইচই বেশি হলেও এর ইতিহাস তেমন বড় নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলেও এ পর্যন্ত বৈধ হয়েছে বা কর দিয়ে কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র ৪৭ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত এ উপায়ে বৈধ হয়েছে মাত্র ২৫ কোটি টাকা। ১৯৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত সাদা হয়েছে ৫০ কোটি। আর ১৯৮১-৯০ সাল পর্যন্ত সাদা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। ১৯৯১-৯৬ পর্যন্ত সাদা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। এরপর ১৯৯৭-২০০০ সাল পর্যন্ত বৈধ হয়েছে ৯৫০ কোটি টাকা। পরে, ২০০১-০৭ পর্যন্ত সাদা হয়েছে ৮২৭ কোটি টাকা। ২০০৭-০৯ সাল পর্যন্ত কালো টাকা সাদা হয়েছে ১৬৮২ কোটি। এরপর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মেয়াদে ২০০৯-১৩ সাল পর্যন্ত ১৮০৫ কোটি, ২০১৩-২০ পর্যন্ত ১১,১০৭ কোটি এবং কোভিডকালীন সময়ে কর পরিশোধের মাধ্যমে বৈধ করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর বিবরণীতে দেখানোর সুযোগ নিয়েছেন অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা।
অর্থনীতির স্বাভাবিক ধারায় ফেরত আনতে বারবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলেও এ সুযোগ নিয়েছেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। এর অন্যতম কারণ অর্থপাচার। কারণ যারা কালো টাকা আয় করেন তাদের বেশিরভাগই দেশে টাকা রাখেন না। যারা রাখেন, তারাও ভয়ে এনবিআরের ধারেকাছে যান না। এর বিশেষ কারণ রয়েছে। ২০০৮ সালে ঘোষণা দিয়ে সরকার বলেছিল কেউ অবৈধ টাকা কর দিয়ে বৈধ করলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। সেই সময় ট্রুথ কমিশন বা সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন গঠন করে সেই সুযোগ দিয়েছিল সরকার। সেই সময় প্রায় সাড়ে চারশ’ রাঘববোয়াল ও দুর্নীতিবাজ আমলারা সেই কমিশনে গিয়ে কর দিয়ে অনুকম্পা নিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের রায়ে সেই কমিশন পরে বিলুপ্ত হয়। পরে, ট্রুথ কমিশনের নথিপত্র নিয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। আটকে যান অনুকম্পা পাওয়া বেশক’জন। এরপর ভয়ে সরকারের অ্যামনেস্টির সুযোগ নিতে যান খুব কম সংখ্যক মানুষ।
সরকারও কিন্তু কম যায় না। কর্তাব্যক্তিরা জানেন, কত দ্রুত তৈরি হচ্ছে কালো টাকা। যদিও ব্ল্যাক মানি মার্কেট নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবুও কানাডার বেগমপাড়ার মতো বিভিন্ন দেশে অর্থ-বিত্ত গড়ে তুলছেন অনেকে। যদি কিছু কর পাওয়া যায় সেই আশায় এবারও ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ফেরত এনেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অন্য করদাতারা যেখানে তাদের আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ কর দেন, সেখানে অবৈধ উপায় বা ভিন্নভাবে আয় করা অর্থের জন্য মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছেন তিনি। ৭ জুন শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম অকপটে স্বীকার করেছেন, ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তার ভাষায়, ‘কালো টাকা প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। কারণ কালো টাকা যারা তৈরি করেন তারা দেশের অর্থনীতির জন্য ব্যবহার করেন না। কালো টাকা মূলত দেশের বাইরে চলে যায় এবং ভোগবিলাসের কাজে ব্যয় হয়। দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা ব্যবহার হয় না’। এ চিন্তা থেকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, বিভিন্ন কারণে অপ্রদর্শিত কিছু সম্পদ থাকতে পারে। অসতর্কতার জন্য, অজ্ঞাত কারণ বা অন্যের মাধ্যমে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার কারণেও অনেকের সম্পদের তথ্য অপ্রদর্শিত থেকে যায়। এসব সম্পদ নিয়ে সমস্যায় পড়েন বলে অনেক ব্যবসায়ী আবেদন করেছেন। আবার জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রেও কিছু টাকা অজ্ঞাতে কালো হয়ে যায়। সেসব বিবেচনায় অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ সুযোগ বিশ্বের অনেক দেশেই দেয়া হয় বলে উল্লেখ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্ন ছিল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদসহ উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও কী ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তাদের অবৈধ অর্থ সাদা করতে পারবেন? জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, ‘তার টাকা মামলায় পড়ে গেছে। এটা সাদা করার সুযোগ নেই। কারণ ফৌজদারি মামলা চলছে। তবে, অন্য কালো টাকার মালিক যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই তাদের সম্পদ কর দিয়ে বৈধ করতে বাধা নেই। একই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান বলেন, বেনজিরকে এখনই জেল-জরিমানা বা ফাঁসি দেয়া হবে বিষয়টি এমন নয়। তদন্ত শেষে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সৎ করদাতাদের তুলনায় অর্ধেক কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার চরম সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থমন্ত্রীর এমন প্রস্তাবকে ‘বে-নজির’ বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এর মধ্য দিয়ে সত্যিকারের করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।