ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন কিশোরগঞ্জ জেলা। কিশোরগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত। ঐতিহাসিক নিদর্শন, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এটি বিখ্যাত। প্রাচীনকাল থেকেই কিশোরগঞ্জ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল। কামরূপ রাজ্যের অংশ ছিল। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল, বর্মণ ও সেন রাজারা এখানে শাসন করেছিলেন। পরে কোচ, হাজং, গারোদের ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনকালে এটি একটি মহকুমা ছিল। ১৯৮৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলা হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে।
কিশোরগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস:
কিশোরগঞ্জ নামের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু জনপ্রিয় মতবাদ প্রচলিত রয়েছে।
১) নন্দকিশোরের গঞ্জ:
ষষ্ঠ শতাব্দীতে বত্রিশ গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ষষ্ঠতম সন্তান নন্দকিশোর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি হাট/বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। নন্দকিশোরের নাম অনুসারে এই এলাকার নাম হয় নন্দকিশোরের গঞ্জ। কালক্রমে নন্দকিশোরের গঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জ নামের উৎপত্তি হয়।
২) ব্রজকিশোরের নামানুসারে:
জেলা গেজেটিয়ার অনুসারে, কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের সাত সন্তানের একজনের নাম ছিল ব্রজকিশোর। ব্রজকিশোর এই এলাকায় বসবাস করতেন এবং তার নামানুসারে এলাকার নাম হয় কিশোরগঞ্জ।
আবার, কিছু লোক মনে করেন কিশোরগঞ্জ নামটি কিশোর নামক একটি ফুলের নাম থেকে এসেছে, কেউ কেউ মনে করেন কিশোরগঞ্জ নামটি কিশোর নামক একটি পাখির নাম থেকে এসেছে।
উল্লেখ্য যে,কিশোরগঞ্জ নামের সঠিক উৎপত্তি নিয়ে কোন ঐতিহাসিক ঐক্যমত নেই। উল্লিখিত মতবাদগুলো স্থানীয় জনশ্রুতি ও কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি।
ভৌগলিক অবস্থান:
কিশোরগঞ্জ জেলা ঢাকা থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে ৮টি পৌরসভা, ১৩টি উপজেলা, ১০৮টি ইউনিয়ন, ১৭৪৫টি গ্রাম নিয়ে অবস্থিত।এ জেলার মোট আয়তন ২,৬৮৯ বর্গ কিলোমিটার। এটি উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদী, পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা, দক্ষিণে নরসিংদী জেলা এবং পূর্বে নেত্রকোণা জেলা দ্বারা পরিবেষ্টিত। জেলাটিতে বেশ কিছু নদী, হাওর ও বিল রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও কিশোরগঞ্জঃ
কিশোরগঞ্জ জেলা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত কালীহরি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের প্রধান কেন্দ্র। এছাড়াও, পাকুন্দিয়া, ভৈরব, করিমগঞ্জ, ইত্যাদি উপজেলায়ও গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল।
স্থানীয় জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্য, ওষুধ, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিশোরগঞ্জ জেলার অসংখ্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এবং বীরত্বের জন্য সম্মানিত হন। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুহাম্মদ রফিক, বীরবিক্রম শফিউল ইসলাম, বীরবিক্রম আব্দুল হাকিম, বীরবিক্রম আব্দুল মজিদ, বীরগণ মোঃ আব্দুল হক, মোঃ আব্দুল ওয়াহাব, মোঃ জাহাঙ্গীর, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ আব্দুল মালেক, ইত্যাদি।
দর্শনীয় স্থান:
কিশোরগঞ্জ জেলায় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ-
- পাকুন্দিয়া বাজারঃ ঐতিহাসিক বাজার এবং হিন্দু মন্দিরের জন্য বিখ্যাত।
- শ্রীমঙ্গলঃ চা-বাগান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
- হাওড়াঃ মনোরম হাওড় ও নৌকা ভ্রমণের জন্য বিখ্যাত।
- কৃষ্ণগঞ্জঃ ঐতিহাসিক স্থাপনা ও মসজিদের জন্য বিখ্যাত।
- বাজিতপুরঃ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও মন্দিরের জন্য বিখ্যাত।
সংস্কৃতি:
কিশোরগঞ্জ জেলা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত।এখানে বিভিন্ন ধরনের লোকশিল্প, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের চর্চা করা হয়। কিশোরগঞ্জের মুখোশ, থ্রি-পিস, লালময়নাতি, টিয়া নৃত্য, হুড়োহুড়ি গান, জারি-সারি গান, মৃদঙ্গ বাদন, খোল বাদন, শঙ্খ বাদন, বাঁশি বাদন, বীণা বাদন, তবলা বাদন, ইত্যাদি বিখ্যাত।
বিশেষ ব্যক্তিত্বঃ
বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ও সুকুমার রায়, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের মত ব্যক্তিত্ব কিশোরগঞ্জের গর্ব।
অর্থনীতি:
কিশোরগঞ্জ জেলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। ধান, পাট, গম, আখ, শাকসবজি ও ফল এখানকার প্রধান ফসল। এছাড়াও রয়েছে মৎস্য, পশুপালন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে।
কিশোরগঞ্জ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্য বিখ্যাত একটি জেলা।