প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার প্রথম বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা করেন এবং সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্যে জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু প্রতারণামূলক কথা উচ্চারণ করেন। তিনি এই হত্যা আর অভ্যুত্থানকে ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনে করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘সকলেই এই শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছিলো। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে পরিবর্তন সম্ভব ছিল না বলেই সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছিলো। সেনাবাহিনী জনগণের জন্যে সুযোগের ‘স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে।’ মোশতাক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এও প্রতিজ্ঞা করেন যে, এই সরকার কখনও কোনো ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা সামাজিক অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করবেন না। কিন্তু তিনি সত্যের অপলাপ করেছিলেন। কারণ, হত্যার মত জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গে তিনি আপোষ করে চলেছিলেন।
বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারেও খন্দকার মোশতাক জনগণের সঙ্গে সততার পরিচয় দিয়েছেন।
মেজর ডালিমের ঘোষণায় সেদিন সকাল বেলায় প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো যে, বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। ফারুক আর রশিদেরও ঠিক একই রকম ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু মোশতাক অন্যচিন্তা লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি পাল্টাতে চাইলেন না। কিন্তু ঐ মুহূর্তে তিনি সুচতুরভাবে এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তই জনগণের কাছে ঘোষণা করা থেকে বিরত রইলেন। এর পরিবর্তে তিনি প্রত্যেককে বোকা বানিয়ে তার ভাষণের শুরুতে আল্লাহর নামটি জুড়ে দেন এবং “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে শেষ করেন। তার ভাষণের আগাগোড়া বিভ্রান্তি আর প্রতারণায় ভরপুর ছিল। ভাষণের পরে ৮৫ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশের জনগণের মনে একটা ধারণার জন্ম নিলো যে, দেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম হতে যাচ্ছে। কিন্তু তিক্ত সত্যটি তারা পরে জেনে ফেলেছিলো। বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার আর তাঁর অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য সাধনের ঘোষণা অপরিবর্তিতই ছিল। মোটকথা, প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদ আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যই বহন করে চলছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে খন্দকার মোশতাক তার অবস্থা মজবুত করে নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে অভিযোগ তোলার আর সময় ছিলো না।
ব্রিটেনবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে খন্দকার মোশতাকের ভাষণ একটা সাংঘাতিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ডালিমের প্রথম ঘোষণায় বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার কথা শুনে সেখানকার ধার্মিক মুসলমানেরা উল্লসিত হয়ে উঠে। কিন্তু খন্দকার মোশতাকের বেতার ভাষণের মূল বিষয়টি জানার পর তারা নিতান্তই হতাশ হয়ে পড়ে। ভাষণের ব্যাখ্যা চেয়ে শত শত টেলিফোন কল লন্ডনের বাংলাদেশি দূতাবাসকে অতিষ্ঠ করে তুলে।
তাদের একজন ডেপুটি হাই কমিশনার ফারুক চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাংলাদেশ কি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে, না কি হয়নি?’ ডেপুটি হাই কমিশনার জানায় যে, তা ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়নি। তখন অত্যন্ত দুঃখ করে ঐ লোকটি বলে, ‘এটাই যদি হবে, তবে আপনারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছেন কেন?’ (আবদুল মতিন)
মোশতাকের বিভ্রান্তিকর ভাষণে বাংলাদেশিরাই কেবল বিব্রত হয়নি। দেশটিকে ইসলামি প্রজাতন্ত্ররূপে ঘোষণা দেয়ার প্রশ্নে সৌদি আরব উল্লাসিত বোধ করে। তারা বাংলাদেশের জনগণের বহুবার শুভেচ্ছাবাণী পাঠালেও প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দান স্থগিত রাখে। কারণ, তাদের ধারণা ছিলো, মুসলমান জনগণের জন্যে একটি ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হওয়া উচিত।
বাদশাহ খালেদের নেতৃত্বে সৌদি আরব যখন শুনতে পেলো, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে এবং দেশটিকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তখন তারা বাংলাদেশের জন্যে বহুদিনের অস্বীকৃত-স্বীকৃতি নিয়ে এগিয়ে আসেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, মোশতাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে কী ধরণের বাক্যজালের সৃষ্টি করে তা আদায় করেছিলেন, তা জানা নেই। তবে এটা সত্যি যে, নতুন প্রেসিডেন্ট দেশটির ‘ধর্মনিরপেক্ষতা চরিত্রটির কোনো পরিবর্তন সাধন করেন নি।
খন্দকার মোশতাক তার পরিকল্পনা মতো কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রথমেই তিনি সামরিক শাসন জারি করে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্যে কারফিউর নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু তাহলে কি হবে? এখানেও তিনি সাধারণ মানুষের ধার্মিক চেতনায় একটু রস লাগানোর ব্যবস্থা করলেন। তিনি একটুখানি কষ্ট স্বীকার করে হলেও শুক্রবারে জুম্মার নামাজ আদায় করার সুযোগের জন্যে তিন ঘন্টা সময় কারফিউ শিথিল করেন। তারপর তিনি একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন। দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রীপরিষদ গঠন করেন। এতে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ লোকদেরকে বাদ দেন। নতুনদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আর ড. এ আর মল্লিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজনকে বরখাস্ত করেন এবং তাদেরকে কারাগারে পাঠান। মোশতাকের নির্দেশে গাজী গোলাম মোস্তফা ও আবদুস সামাদ আজাদসহ অনেক রাজনীতিবিদকে আটক করা হয়। তিনি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হন। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন নতুন শাসনের জয়গানে মত্ত হয়ে ওঠে। পালা বদলের জন্যে চাটুকারদের কোনো পৃষ্টপোষকতার প্রয়োজন হয়নি। মোশতাক আহমেদকে অভিনন্দন জানানোর জন্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে চাটুকারদের ভিড় জমে উঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে এক ফোঁটা চোখের পানিও কেউ ফেললো না বলে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে বলা হল। মওলানা ভাসানী কয়েক মাস। আগেই কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতি তার অনাস্থার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। এক্ষণে তিনি সময় ক্ষেপণ না করে খন্দকার মোশতাকের সরকারের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানও তার আনুগত্য স্বীকার করে।
ঢাকার ধানমন্ডিতে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রমাণাদি মুছে ফেলার জন্যে খন্দকার মোশতাক অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, সেরনিয়াবাত আর শেখ মনি’র পরিবারের সবাইকে নীরবে বনানী গোরস্থানে কবরস্থ করার বন্দোবস্ত করা হয়। কেবল বঙ্গবন্ধুর লাশ একটি বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তাঁর নিজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার তাঁর পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরের মতে, অভ্যুত্থান আর তাঁর হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু গ্রামবাসী মিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৈত্রিক বাড়ি লুট করে। সম্ভবত এটাই তাঁর সর্বশেষ অবমাননা।
খন্দকার মোশতাক আহমেদকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত করে ফারুক এবং রশিদ সেনা সদরে ফিরে গিয়ে যোগদান করতে চাইলে, তাদেরকে যোগদান করতে দেয়া হলো না। সামরিক কমান্ডাররা তাদেরকে ভয় পাচ্ছিলো। খন্দকার মোশতাক এই সমস্যার সমাধান করেন। তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যে তিনি দুই মেজরকে সার্বক্ষণিকভাবে তার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার ব্যবস্থা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাতের ব্যাপারে খন্দকার মোশতাক মেজরদেরকে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। এখন আবার তিনি তাদেরকে সুরক্ষার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু এতসব করলেও তার পূর্বসূরির মতো তিনিও মূলত সকল সামরিক বিষয়াদির প্রতি অবিশ্বাস আর অপছন্দ মনে মনে দৃঢ়ভাবে পোষণ করতেন। তিনি নিজেও একজন গোড়া আওয়ামীপন্থী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্যে তিনি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসনকালে তিনি সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্যে নিবিষ্ট চিত্তে চেষ্টা করেন।
কিন্তু তাকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ছিলো সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধানের পদটি নিয়ে। রশিদ আর ফারুক সেনাবাহিনী প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর পরিবর্তে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্থলাভিষিক্ত করতে চাচ্ছিলো। পরে মোশতাকের সমর্থন না থাকলেও তারা তাদের পছন্দমতো বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে অন্য একজনকে নিয়ে আসে। এই লোকটির নাম গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াব। তোয়ার কলকাতায় প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন বিমান বাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করেন। তোয়াব তখন অবসর গ্রহণ করে তার জার্মান বংশোদ্ভূত স্ত্রীকে নিয়ে মিউনিখে বসবাস করছিলেন। রশিদ তাকে নিয়ে আসার জন্যে জার্মানিতে যান।
মোশতাক দু’টি কারণে জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান হিসেবে নিয়োগ করতে অনীহা পোষণ করেছিলেন। প্রথম কারণ ছিলো, জিয়ার প্রতি তার অবিশ্বাস। দ্বিতীয়ত; অন্যান্য সিনিয়র আর্মি অফিসারদের ব্যতিক্রম হিসেবে জিয়া তাঁর সৈনিকদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। এটা ছিলো মোশতাকের জন্যে একটা অসহনীয় ব্যাপার। কারণ, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, এই ধরণের কমান্ডারকে অবশ্যই একজন সম্ভাব্য বিপদজনক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করতে হবে। সুতরাং তিনি তার পক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাটাই অবলম্বন করলেন। তিনি জিয়াকে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান নিয়োগ করলেন। কিন্তু তার অবস্থান সঠিকভাবে সুদৃঢ় রাখার বন্দোবস্ত করে নিলেন। তিনি তার নিজের বাছাই করা একজনকে দিয়ে জিয়ার কর্ম তৎপরতা তদারকির ব্যবস্থা করলেন।
রশিদ সেনাবাহিনীর সকল ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে উপদেশ প্রদানের কথা। কিন্তু তিনি রশিদকে না জানিয়েই তিন বাহিনীর প্রধানের উপরে কর্তৃত্ব স্থাপন করার জন্যে একটি পদ সৃষ্টি করেন। এই পদের নাম দিলেন- ডিফেন্স স্টাফ প্রধান। ডিফেন্স স্টাফ প্রধান হিসেবে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে নিয়োগ প্রদান করেন। মেজর জেনারেল এরশাদ তখন ভারতের একটা স্টাফ কোর্সে নিয়োজিত। তাকে চার মাসের মধ্যে দ্বিতীয় প্রমোশন দিয়ে জিয়ার ডেপুটি নিয়োগ করা হয়। পদোন্নতির দিক দিয়ে জিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে জিয়ার অধীনে চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবেই রাখা হলো। এই সকলের ঊর্ধ্বে জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীকে তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করলেন। ওসমানী ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল ইন চিফ এবং তাকে তিনি সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করতেন বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রকৃতপক্ষে মোশতাক উল্টো পথেই ইটিছিলেন। তার কার্যকলাপের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দুঃখভরে ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর পরে বলেছিলেন, ‘প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতি দুর্ব্যবহারের দিক দিয়ে মোশতাক পূর্বের যে-কোনো অবস্থাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চতুর এবং ধূর্ত। তিনি একজনকে আর একজনের পেছনে লাগিয়ে রাখতেন। এমনকি সরকারি আমলাদেরও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময় জেনারেল জিয়া উপস্থিত ছিলেন। তিনিও তার কথার সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন।
২৬ সেপ্টেম্বর মোশতাক এক অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের তাদের কৃত অপরাধ থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। এই অধ্যাদেশটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে ‘দি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫’ নামে গেজেট নোটিশে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু পত্র- পত্রিকায় স্বাভাবিকভাবে তা প্রচার করা হয়নি। কারণ, পত্র-পত্রিকায় এ খবর প্রকাশ হয়ে গেলে জনসাধারণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারতো।
এই গোপন আইনটির মাধ্যমে মেজরদের সকল প্রকার অপরাধকে পরিপূর্ণভাবে ক্ষমা করে দেয়া হলো। কেবল তাই নয়, ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত, পরিকল্পনা, কুমন্ত্রণা, হত্যা ইত্যাদি সকল কাজের জন্যে মেজরবৃন্দ এবং তাদের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে বেকসুর মাফ করে দেয়া হলো। যিনি এই নুতন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি জাতির জনক আর তাঁর পরিবারের ২১ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, তাদের জন্যে গোপনে ক্ষমা ঘোষণা আসলেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাপার এবং ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা।
খন্দকার মোশতাক যেভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বুকের তাজা রক্তের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে এসে গদিতে বসেন, সেই অবস্থায় অবশ্য কেউ প্রত্যাশা করেনি যে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার করবেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া স্পষ্টতই একটি অপরাধ। রশিদ ও ফারুকই এই আইনটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। কূটতার্কিক মোশতাক, নিজেও তার চলার পিচ্ছিল পথে একটা ছোট্ট খুঁটি হিসেবে এই কর্মটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
তিনি তো বেশ সুচতুরভাবেই অনেককে ‘নিরাপত্তা সনদ’ প্রদান করলেন। কিন্তু তিনি তার নিজের জন্যে এই ‘নিরাপত্তা সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন কি-না, তা জানা নেই। তবে নিশ্চিত সত্য যে, এই অধ্যাদেশের শর্তগুলো এই কর্মকে নিয়মানুগ করতে গিয়ে ব্যাপক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
হত্যাকারীদের ক্ষমা ঘোষণা, ফারুক ও রশিদকে লে: কর্নেল-এ পদায়ন এবং বেতার ভাষণে তাদেরকে ‘সেনাবাহিনীর সূর্যসন্তান’ বলে প্রশংসার যে বন্যা বইয়ে দেন তাতে সেনাবাহিনীর মনোবল এবং শৃঙ্খলায় ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে। পরিষ্কারভাবে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বিদ্রোহ, ধ্বংস, হত্যা সেনাবাহিনীর অফিসার আর জোয়ানদের জন্যে অনুমোদনযোগ্য। কেবল ধরা না পড়লেই হলো। এসব কারণেই পরবর্তীতে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান আর সাত বছর পরে চট্টগ্রামে জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাও সংঘটিত হয়।
এই সময়ের মধ্যেই মোশতাক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সম্ভাব্য সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দেয়ার ধূর্ত ও ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি হিসেব কষে দেখলেন যে, সেনাবাহিনীকে বাদ দিলে, আসল হুমকি আসবে তারই পুরনো পার্টি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিরোধী দলীয় শক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে। সুতরাং যখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকে তিনি কিছুটা সামাল দিতে পেরেছেন, তখনই আর বিলম্ব না করে মুজিবনগর সরকারের চারজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানকে বন্দী করে জেলে পাঠান।
এই চার নেতা জেলে থেকে এক আকস্মিক ষড়যন্ত্রের’ শিকার হয়। এই ষড়যন্ত্রের ফলেই মাত্র দু’মাস পরে এই জেলখানার ভেতরেই তাদেরকে পৈশাচিকভাবে খুন করা হয়। খুন করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফারুক এক সময় বলেছিল যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমাকে ওরা যেভাবে উৎখাত করেছে, সেভাবে খন্দকার মোশতাকও তো উৎখাত হতে পারে। এই অবস্থায় ভারতের সহায়তায় কোনো পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে গেলে জেলের চার নেতার যেকোনো একজনকে টেনে এনে পাল্টা সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হবে। সুতরাং তাদেরকে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে নিজেদের নিরাপদ বলে মনে করতে থাকেন।
এদিকে দেরিতে হলেও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো। এতে মোশতাকের মনোবল কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সকল প্রচারযন্ত্রের হার মানিয়ে মোশতাকের নীতিমালার প্রতি জনগণের ব্যাপক বিভ্রান্তি গুঞ্জরিত হতে লাগলো। একদিকে কিছু পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন কথাবার্তা আর ইসলাম ইসলাম বলে বাজার গরম করার প্রয়াস। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নীতিকে দু’হাতে শক্তভাবে ধরে রাখার অপপ্রয়াস । এই বৈপরিত্যপূর্ণ অদ্ভুত দিকটি ১৯৭৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর একটি সরকারি শ্বেতপত্রে তুলে ধরা হয়।
বঙ্গবন্ধুকৃত ভুলকর্ম জনসমাজে তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি চিহ্নিত করার জন্যে খন্দকার মোশতাক একটি ‘অর্থনৈতিক টাস্ক ফোর্স’ নিয়োগ করেন। এই টাস্ক ফোর্স ১২ দিনের রেকর্ড সময়ের মধ্যে তাদের রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিল করে। এতে কিছু অস্পষ্ট অতিকথন সন্নিবেশিত করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের চারটি স্তম্ভকে (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ) রাষ্ট্রের চার মূলনীতি বলে ধরে নিয়ে রিপোর্টের বিভিন্ন দিক ও সমাধানের বিশ্লেষণ করা হয়। ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনে’ ক্ষমতায় এসে খন্দকার মোশতাক সরকারের প্রথম শ্বেতপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতিমালাকেই জাঁকজমকভাবে জনগণের মুক্তির পথ মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়। জনগণ এতে অবাক হতবুদ্ধি হবে, এতে আর বিচিত্র কি আছে? এসব দেখে মেজররা দিন দিন অধিক থেকে অধিকতর দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিলো। তাদের মনে প্রশ্ন জাগলো, ‘তা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার কী দরকার ছিলো?’
৩ অক্টোবর, ১৯৭৫ সাল। খন্দকার মোশতাকের শাসন ৫০ দিনে উন্নীত হয়েছে। মোশতাক ‘জনগণের হৃত গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত’ রেডিও ও টেলিভিশনে ঘোষণা করেন। সুচতুরভাবে, প্রচুর সময় হাতে রেখে, তিনি ঘোষণা দেন যে, ১৫ আগস্ট (১৯৭৬ সাল) থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হবে। আর পার্লামেন্টারি সরকার গঠনের জন্যে ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৭ সাল) সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ধূর্ত রাজনৈতিক চালটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। এবং সকল রাজনৈতিক বন্দী মুক্তির সরকারি ঘোষণাটি আরও বেশি সমাদৃত হয়। মোশতাক সুষ্ঠুভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ‘রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এখন আর কোনো “আটকের হুলিয়া’ রইলো না।’ মোশতাক আরো একবার চরম মিথ্যার আশ্রয় নিলেন। অন্ততপক্ষে, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানের মতো চারজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তালাবদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। তাদের খুব শীগ্রই মুক্তির কোনো সম্ভাবনাই জানা ছিলো না।
মোশতাক তার ভাষণে মেজরদেরকে সেনাবাহিনীর ‘সাহসী সূর্যসন্তান নামে আখ্যায়িত করে তাদের কাটা ঘায়ে মলম লাগানোর ফন্দি আটলেন। কিন্তু জনগণ তার গলাভরা বুলি প্রত্যাখ্যান করলো। সাত সপ্তাহ ধরে তারা সেই সূর্যসন্তানদের কেবল কলঙ্কজনক দিকগুলোই শুনে আসছিলো। চাটুকার সভাসদের দল, দুর্নীতিবাজ আমলা শ্রেণি, ব্যবসায়ী মহল সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই আবার যার যার কাজে বসে পড়ে। তারা আসল ক্ষমতার উৎস খুঁজে পেয়েছিলো। ফারুক স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, টাকা বাদ দিলেও, আমি লক্ষ লক্ষ ডলার এক সপ্তাহের মধ্যে হস্তগত করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেই লোকদের চেহারাও দেখতে চাইনি।’ রশিদ নিশ্চিত করে বলে ছিলেন যে, অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত এমন কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার প্রচুর টাকা বানিয়েছে বলে তার কাছে খবর আছে।
আর্টিলারি আর ল্যান্সারের কিছু অফিসার, এমনকি জোয়ান আর এনসিও-রাও বাদ যায়নি। যে যেভাবে পেরেছে, দু’হাতে লুটেছে। সুতরাং ফারুকের ‘বিপ্লব’ সরকারি শাসনযন্ত্র নির্মূল করার মহান অভিযান বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আসল উদ্দেশ্য, তার মতে, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিলো। (Lawrence Lifschultz)
ফারুক আর রশিদের আরো কিছু চিন্তার ব্যাপার ছিলো। প্রথমত, মোশতাক তাদের কথায় কান দিচ্ছিলেন না। তাদের যেকোনো পরামর্শ তিনি ‘আমলাতন্ত্রের গোলক ধাঁধায় ফেলে দিতেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে।’ কিন্তু সেগুলো নিশ্চিতভাবে নথির ভেতরে কবরস্থ হয়ে যেতো। দ্বিতীয়ত; ফারুক আর রশিদকে দূরে রেখে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সকল ‘গৌরব’ মোশতাক আর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর নিজেরাই নিতে সচেষ্ট ছিলেন। অথচ, ফারুক আর রশিদ এ জন্যে জনগণের স্বীকৃতি মনে-প্রাণে কামনা করছিলো।
‘হঠাৎ করেই মোশতাক আর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর নায়ক বনে গেলো, অভিযোগ করে ফারুক।’ রশিদও একমত। খন্দকার মোশতাকের আমাদের প্রতি অন্তত কিছুটা কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিলো। কেননা, আমরাই তাকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্যে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। তিনি তো তরতাজা রাজনীতিবিদ। বিশ্বাসঘাতকতা তার স্বভাব আর তা রক্তে মিশে আছে। তিনি কখনও সোজা পথে চলতেন না।’ এটা ছিল খন্দকার মোশতাকের বৈশিষ্ট্য। পলাশীতে মীর জাফর আলী খান বাংলার জন্য যেমন অনিষ্টের কারণ ছিলেন বাংলাদেশে খন্দকার মোশতাক তেমনি ভূমিকা রেখে গিয়েছেন। বাংলার ইতিহাসে তিনি চিরদিন ঘৃণিত চরিত্র।