ছোট থেকে বড় আমরা সবাই সিনেমা দেখতে কমবেশি ভালোবাসি। বয়সের সাথে সাথে সিনেমার জনরা নিয়ে নানা বিভক্তি থাকলেও বলিউড,হলিউড,ঢালিউড সিনেমা আমাদের বিনোদনের অন্যতম বড় একটা মাধ্যম এটা বলার অপেক্ষা রাখেন। আর এই সাবকন্টিনেন্টে সিনেমা বলতেই আমরা তিন ধরনের সিনেমা বুঝি। ইংরেজি সিনেমার জন্য হলিউড , হিন্দি সিনেমার জন্য বলিউড , আর বাংলা সিনেমার জন্য টলিউড ও ঢালিউড। এদিকে এগুলো ছাড়াও দেশের বাইরে হুড়মুড়িয়ে বেড়েছে ভিন্ন ভাষাভাষীর ছবির দর্শক। তবে আজকের আয়োজন মায়ানগরী বলিউড ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে।
ভারতীয় সিনেমা মানেই বলিউড, এক সময় এমনি ধারণা ছিল বেশিরভাগ মানুষের। ভারতীয় সিনেমায় সবথেকে বড় ইন্ডাস্ট্রি বলা যায় বলিউডকে। তৎকালীন বম্বে, বর্তমান মুম্বইকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এই বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। বলিউডের নাম ‘বলিউড’ রাখার পেছনে জায়গাটাই সবথেকে বড় কারণ। আসলে তৎকালীন বম্বে শহরে গড়ে ওঠায় আদ্যক্ষর নিয়ে নামকরণ করা হয়েছিল বলিউড। পাশ্চাত্য সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি হলিউডের অনুকরণে নাম হয় বলিউডের।
হিন্দি ভাষার এই ইন্ডাস্ট্রিতে সারা বছর শত শত সিনেমা নির্মিত হয়, মুক্তি পায়। সেগুলো আবার শত-হাজার কোটি টাকা আয় করে জমজমাট রাখে মুম্বাই নগরীকে। ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হতো বলিউডে। এরপর করোনার বড় ধাক্কা এসেছে। যা সিনে ব্যবসায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অনেকেই বলে থাকেন, হিন্দি সিনেমা মানসম্মত হচ্ছে না বিধায় দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিপরীত দিকে দক্ষিণ ভারতের সিনেমাগুলো দিন দিন দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে বলিউডের আয়ের বা বিজনেস মডেল নিয়ে আজ একটু বিস্তারিত আলাপে যাই, চলুন!
বলিউড সিনেমার লাভ-লোকসানের বিষয়গুলো একটু জটিল। সেটা ভালোভাবে বুঝতে হলে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে বলিউডের বিজনেস মডেল সম্পর্কে। বলিউডের একটা ফিল্ম কীভাবে পয়সা কামায়, সেটা আলোচনা করার আগে, ফিল্ম নির্মাণ প্রক্রিয়ায় দিকে একটু চোখ বুলিয়ে আসা দরকার। চলচ্চিত্র নির্মাণের দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে মোট পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ডেভেলপমেন্ট, প্রি-প্রোডাকশন, প্রোডাকশন, পোস্ট-প্রোডাকশন ও ডিস্ট্রিবিউশন।
প্রত্যেকটা ধাপেই প্রচুর অর্থ খরচ হয়। ভালোমানের একটা বলিউড সিনেমা বানাতে বর্তমানে যে পয়সা লাগে, তা একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বহন করা মোটামুটি অসম্ভব। এভারেজ মেইনস্ট্রিম বলিউড ফিল্মের বাজেট বর্তমানে ৫০ কোটির আশেপাশে হয়ে থাকে। আবার বিগ বাজেটের ফিল্মের জন্য অনেকগুলো প্রযোজনা সংস্থা একসাথে অর্থ লগ্নি করে। যেমন, ৩০০ কোটি রুপি বাজেটের ব্রহ্মাস্ত্র সিনেমার প্রযোজনা সংস্থা হিসেবে যুক্ত ছিল ধর্ম প্রোডাকশন, প্রাইম ফোকাস, এবং স্টার স্টুডিয়ো। যদি প্রযোজনা সংস্থার বদলে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি সিনেমা প্রযোজনা করলে কাজটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
সিনেমার শুটিং, প্রোডাকশন, পোস্ট প্রোডাকশন- এসব সামলানো পরিচালকের দায়িত্ব। তিনি সাধারণত প্রতি মুভিতে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিপরীতে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। সকল সম্পাদনার পর ফিল্ম পুরো তৈরি হয়ে গেলে সেটা হয়ে যায় প্রযোজকের সম্পত্তি। তারপর প্রযোজক বা প্রযোজনা সংস্থা সেটা নিয়ে যান ডিস্ট্রিবিউটারের কাছে। ডিস্ট্রিবিউটরের কাজ হলো সিনেমাটিকে থিয়েটার এবং ওটিটি প্লাটফর্ম পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। ফিল্মের বিজ্ঞাপন ও প্রচার-প্রচারণার এক অংশের দায়িত্বও পালন করে থাকেন ডিস্ট্রিবিউটর। প্রেক্ষাগৃহ ছাড়াও ডিস্ট্রিবিউটর ফিল্মের অর্থ আয় করে থাকে স্যাটেলাইট রাইটস, ডিজিটাল স্ট্রিমিং রাইটস বিক্রির মাধ্যমে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের কাছেও তারা এই সিনেমা বিক্রি করে থাকে, যেটাকে ওই নির্দিষ্ট টিভি চ্যানেল ‘World TV Premier’ ট্যাগ দিয়ে মহাসমারোহে সম্প্রচার করে থাকে। এছাড়াও প্রযুক্তির এই সয়লাবের যুগে ডিস্ট্রিবিউটর ওটিটির কাছে রেকর্ড দরে মুভি বিক্রি করে থাকে।
যেখান থেকে সিনেমা দেখার টিকেট কেনা হয়, সেটাকে বলে বক্স অফিস। আর একটা সিনেমা সিনেমা হল থেকে যে অর্থ আয় করে, তা হলো বক্স অফিস কালেকশন। এই অর্থ সংগ্রহ করেন থিয়েটার মালিকরা। এজন্য আবার সরকারকে GST (Goods and Services Tax) দিতে হয় থিয়েটার মালিকদের। টিকিটের দাম ১০০ রুপির বেশি হলে ১৮% GST, আর ১০০ রুপির কম হলে ট্যাক্স দিতে হয় ১২%। সরকারের ভাণ্ডারে এই কর জমা দেওয়ার পর হল মালিকদের কাছে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো নেট কালেকশন। যদি ফিল্মের নেট কালেকশন ফিল্মের বাজেটের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে ওই ফিল্মকে লাভজনক/প্রফিটেবল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বর্তমানে তাই সিনেমা বানাতে যেমন খরচ হয় বলিউডের, তেমনি আয় করার মাধ্যমও অনেক। ‘স্পন্সরশিপ, কলার টিউন, টিভি রাইটস, হল রিলিজ, টেবিলমানি, অগ্রিম বুকিং, বিকল্প প্রদর্শন ও বর্হিবিশ্বে রিলিজ’ ছাড়াও বড় অঙ্কের মাধ্যম ওটিটি প্লাটফর্মগুলো। মুভি হিট হলে পকেটে লাভের অংশ ঢুকে, আর ফ্লপ হলে আম, ছালা দুটোই শেষ।
রিস্ক থাকলেও সেটা মিনিমাইজ করে প্রতিনিয়ত বিনোদনের নানা রকম পসরা নিয়ে হাজির হচ্ছে এই স্বপ্ননগরী মুম্বাইয়ের ঝা চকচকে বলিউড ইন্ডাস্ট্রি। ভারতের অর্থনীতেও এই বলিউড ইন্ডাস্ট্রির একটা ভালো রকমের কন্ট্রিবিউশান লক্ষ্য করা যায়। সব মিলিয়ে বলিউড ইন্ডাস্ট্রি যে শুধুমাত্র বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি হিসেবেই পরিগনিত হচ্ছে তেমনটা নয়, সাথে সাথে বেশ বড় একটা জনসংখ্যা এই ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত থাকার ফলে দেশের অর্থনীতি, শিল্পের নানা মাধ্যম ও উপকৃত হচ্ছে এই বলিউড থেকেই।