১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েম কর্তৃক জারিকৃত ফরমান অর্থাৎ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা রহিত আদেশটি গৃহীত হয়।
১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৮ বাতিল। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধী কিংবা যোগসাজশকারীরা নির্বাচনে ভোটদান বা প্রার্থী হতে পারবেন। এদের বিচারের জন্য গঠিত বিশেষ ট্রাইবুনাল বিলুপ্ত।
৭২ এর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল তবে
ক. সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাবান ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হবেন।
খ. মোট মন্ত্রী সংখ্যার এক পঞ্চমাংশ অনির্বাচিত হতে পারে।
গ. প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীপরিষদ রাষ্ট্রপতির নিকট দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঘ. সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কোন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারবেন। সিনিয়র দুইজন বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে ৩ সদস্যের কাউন্সিল হবে।
ঙ. ১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর এর সামরিক আদেশ অর্থাৎ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৮০, ৯২ (ক) এবং ১৪২ এর পরিবর্তন বা সংশোধনী করতে হলে তা গণভোটে পাশ করতে হবে। সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে উক্ত অনুচ্ছেদগুলো সংশোধন করা যাবে না। গণভোটে অনুমোদিত হলে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হবে না।
চ. রাষ্ট্রপরিচালনায় মূলনীতির পরিবর্তন করা হয় অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ৮, ১০ এবং জাতীয়তাবাদ পরিবর্তন করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর একটি ভালোদিক হলো একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি। অন্যগুলো সংবিধানের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করেছে। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকেই সর্বময় ক্ষমতাবান করা হয়েছে। মাননীয় সুপ্রিমকোর্ট পঞ্চম সংশোধনীকে অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ ঘোষণা করে। বলেছেন, সংবিধানে সামরিক আইন বা সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ বলতে কিছু নেই। সামরিক আইনের ঘোষণাই অবৈধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। সংবিধান লঙ্ঘন চিরদিনই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ১৯৭৭ সালের জারিকৃত গণভোট আদেশ একটি অজানা ও সংবিধান বহির্ভূত ব্যবস্থা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়ে যান এবং একই সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন যা সংবিধান সম্মত ছিলো না। অর্থাৎ লাভজনক কোন পদে থেকে রাষ্ট্রপতি কিংবা উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বৈধ নয়।
কেবল মাত্র এ একটি কারণে ঐ সালের ৮ জুলাই সংবিধানের একটি সংশোধন আনা হয় যেখানে বলা হয় রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির পদ অলাভজনক। ইতিহাসে এটির নাম ষষ্ঠ সংশোধনী যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সপদে রেখে সরকারি সুযোগ সুবিধা দিয়ে নির্বাচনে বৈধতা দেয়া। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৩০ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (CMLA) এবং ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। সর্বসাকুল্যে প্রায় ৪৪ মাসের সামরিক শাসনের পর ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনী বিল গৃহীত হয়।
সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) বিল ১৯৭৯ যার বিষয় নামকরণ ছিলো ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বৈধতা দান। এটি ০৪/০৪/১৯৭৯ সালে সংসদে উত্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান, পাস হয় ০৫/০৪/১৯৭৯ এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেই অনুমোদন দেন ০৬/০৪/১৯৭৯ তারিখে। বিলটির পক্ষে ভোট দেন ২৪১ জন সদস্য। বিপক্ষে কেউই ছিলেন না।
পঞ্চম সংশোধনী বিলের বিষয়বস্তু থেকেই এর উদ্দেশ্য বোঝা যায়। বিলটিতে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডসহ ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি প্রদানসহ যাবতীয় সামরিক কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয়া হয়। তাছাড়াও সামরিক শাসনামলের কতগুলো ফরমান বা আদেশ এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন:-
১। ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এ.এম. সায়েম কর্তৃক জারি করা এক দলীয় ব্যবস্থা রহিত করণ আদেশ।
২। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসাজশকারী দোষী ব্যক্তিদের সংসদ সদস্যপদে ভোট দান ও প্রার্থী হওয়ার বিধি নিষেধ (রাষ্ট্রপতি আদেশ নং-৮, ১৯৭২) বাতিল |
৩। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বিধান এর বিলুপ্তি।
৪। মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৮ (ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষেধাজ্ঞা) বাতিল ।
৫। জাতীয়তা বাঙালি এর পরিবর্তে বাংলাদেশি।
৬। সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ শব্দগুচ্ছ স্থাপন।
৭। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন । ৮। ১০ নং অনুচ্ছেদে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাতিল করে এর নতুন ব্যাখ্যা দেয়া হয় “অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার’।
৯। ব্যক্তিগত সম্পত্তি জাতীয়করণের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা প্রদান। জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই একদলীয় ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটালেও রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা বহাল রাখেন এবং নিজে ঐ পদে আসীন থাকেন।
এক্ষেত্রে যে সংশোধনীগুলো অন্তর্ভুক্ত হয় তা নিম্নরূপ।
১। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিকেও রাষ্ট্রপতি মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। তবে তার সংখ্যা মোট মন্ত্রী সংখ্যার এক পঞ্চমাংশের বেশি হবে না। প্রধানমন্ত্রীসহ গোটা মন্ত্রীপরিষদ আগের মতই রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাতেই সপদে বহাল থাকতে পারবেন।
২। রাষ্ট্রপতি পূর্বের মত যে কোন বিল নাকচ করতে পারবেন না, তবে পুনঃবিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাতে পারবেন।
৩। প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি এবং পরবর্তী সিনিয়র দুই বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের রিপোর্টের ভিত্তিতে অসমর্থ কিংবা অসদাচরণের কারণে রাষ্ট্রপতি কোন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারবেন।
৪। ১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর সামরিক আদেশ গৃহীত হয়। অর্থাৎ সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রস্তাবনাসহ অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৮০, ৯২ (ক) এবং ১৪২ সংশোধনের জন্য গৃহীত হলে তা গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ হতে হবে তবেই সংশোধনীটি আইনে পরিণত হবে।
পঞ্চম সংশোধনীর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামরিক হস্তক্ষেপ ও সামরিক শাসনকে সংবিধানে বৈধতা দান। এটি করতে গিয়ে জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূল কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করে দেন। এক দলীয় ব্যবস্থা বাতিল করলেও তিনি রাষ্ট্রপতি শাসন বহাল রাখেন। তিনি সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করে গোটা বাংলাদেশের সংজ্ঞা ও জন্ম ইতিহাস বদলে ফেলেন। তিনি সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামকে যুদ্ধে পরিণত করেন।
এতদকারণে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট যিনি সংবিধানের গার্ডিয়ান বা অভিভাবক এই সংশোধনীকে অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ বলে সমূলে বাতিল করে দেন। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেন ‘বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এখানে থাকবে আইনের শাসন। সংবিধানে ‘সামরিক আইন’ বা ‘সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ’ বলে কিছু নেই। কোনো ব্যক্তি সামরিক আইন ঘোষণা করলে তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। সংবিধান লঙ্ঘন আইনের চোখে গুরুতর অন্যায় এবং তা চিরদিনই অন্যায় বলে গণ্য হবে। এটা কোনোভাবেই বৈধ করা যায় না। জিয়াউর রহমানের জনআস্থা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ১৯৭৭ সালে জারিকৃত গণভোট আদেশ একটি অজানা ও সংবিধান বহির্ভূত ব্যবস্থা’।
[বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী মামলা খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, আহসান কবীর ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিঃ ও অন্যান্য, সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং ১০৪৪/২০০৯ এবং ১০৪৫/২০০৯]