১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে এদেশে সামরিক শাসন শুরু হয় এবং গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ৫ নভেম্বর খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে এবং ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বিচারপতি সায়েমকে সামরিক শাসক পদে বসিয়ে পর্দার আড়াল থেকে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন। লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান পদে থেকেই ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন এবং একই সালের ৩০ মে একটি গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার শাসন কাজের বৈধতা নেন। বলা বাহুল্য ঐ গণভোটে শতকরা ৯৮.৮০ ভাগ “হ্যাঁ” এবং ০১.১২ ভাগ “না” ভোট প্রদত্ত হয়। এ সময়ে গণভোটে বিজয়ী রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনী প্রধান লে. জে. জিয়াউর রহমান প্রথমে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) এবং পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন ন্যাপ (ভাসানী) নেতা মশিহুর রহমান (যাদু মিয়া) এবং মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমানের সাহায্যে। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এ দলে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াত, রাজাকার, আলবদর সহ বেশকিছু দলছুট ব্যক্তি সমবেত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে রাখে।ফলে এ সময়ের রাজনীতি ছিল দুটি ধারায় বিভক্ত প্রথমত: স্বাধীনতার পক্ষশক্তি
এবং স্বাধীনতার বিপক্ষশক্তি অথবা আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং আওয়ামী লীগের বিপক্ষে। এসময় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান চিফ মার্শাল “ল” এডমিনিসট্রেটর হিসাবে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনীর পোশাক পরেই রাজনীতি করতে থাকেন।
অতঃপর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীকে অতি সহজে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং একনাগাড়ে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুনের নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে সামরিক আইনের অবসান ঘটিয়ে তিনি সেনা প্রধানের পদে তারই গুণমুগ্ধ বিশ্বাসভাজন লে. জে. এইচ এম এরশাদকে নিয়োগ করেন যিনি অপর একটি সামরিক অভ্যুত্থানের নায়ক হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছেন। সামরিক আইনের অবসান ঘটিয়ে নির্বাচিত হয়ে রাতারাতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সনের ১৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেন এবং শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হন। বলাবাহুল্য ঐ মুসলীমলীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘে ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে যান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে বিশ্ব জনমত গঠনের কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে শাহ আজিজুর রহমানের প্রধান কাজই ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের যাবতীয় ফরমান ও প্রবিধানের বৈধতা দান। এটি সংবিধানের ৫ম সংশোধনী নামে খ্যাত যা ৫ এপ্রিল ১৯৭৯ সালের জিয়াউর রহমানের সৃষ্ট দল বিএনপি সরকার জাতীয় সংসদে পাস করে এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৬ এপ্রিল তা অনুমোদন করেন। যদিও সংবিধানে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত উল্লিখিত হয়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানই মূলত অনিয়ম আর দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গেছেন । তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেন ‘I will make politics difficult তিনি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেন। প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বাধাগ্রস্ত করতেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও এবং অবৈধ পন্থায় অর্জিত ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেই এ নীতি গ্রহণ করেন। এ কারণে তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি আওয়ামী লীগ বিরোধীদের সমাবেশে পরিণত হয়। সামরিক শাসনের বৈধতা দান ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার লক্ষ্যেই বিএনপি গঠিত হয়। কালের প্রবাহে বহু উত্থান পতন আর বিপুল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকে মূলনীতি করে জিয়াউর রহমান তার সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সমান্তরালে আনতে সক্ষম হন, যার ফলশ্রুতিতে বিএনপির পরবর্তী নেতৃত্ব জিয়াউর রহমানকেও বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে আনার প্রয়াস পান যা জনগণ গ্রহণ করেনি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সমস্ত MLR বৈধতা দানের পাশাপাশি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহ’, ‘জাতীয় মুক্তির’ পরিবর্তে ‘জাতীয় স্বাধীনতা’, ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ পরিবর্তে ‘যুদ্ধের’, নাগরিকত্ব বাংলাদেশি, মূলনীতি সমাজতন্ত্রের সংস্কার ও পরিবর্তন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা’ যোগ, এবং ১২ নং অনুচ্ছেদের বিলোপ করে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে পরিণত করা হয়। কিন্তু দৈব দুর্বিপাকে কংস রাজের রোষানল থেকে শ্রীকৃষ্ণের প্রাণ বেচে যাওয়ার মতই ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই এর প্রথম সংশোধনীটি রক্ষা পায় যার ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীরা বিচারের সম্মুখীন হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ই জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে বলা হয় জাতীয় সংসদ ৪৭(৩), ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ এর বর্ণনা মোতাবেক গণহত্যা জনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপবাদের জন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্যদের যুদ্ধ বন্দিকে আটক কিংবা দণ্ড প্রদান করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করবেন পারবে। অন্যকোনো আইন এর সাথে সাংঘর্ষিক হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার যোগ্য হবে না। সংবিধানের প্রথম সংশোধনী সারা বিশ্বে তখনই ব্যাপক সমাদৃত হয়।