ডলার! শব্দটিতেই একটি ভাব গম্ভীর্য রয়েছে।
ধরুন,আপনি ইন্দোনেশিয়া ঘুরতে যাবেন।সেখানে আপনার থাকার জন্য আপনি হোটেল বুকিং দিবেন কিন্তু সেখানে আপনাকে ডলারে পেমেন্ট করতে হবে,কখনো ভেবে দেখেছেন কি কেনোই বা ডলারে আমাদের পেমেন্ট করতে হচ্ছে,আমরা কেনো বাংলা টাকা বা অন্য কোনো মুদ্রা দিয়ে পেমেন্ট করতে পারছি না?
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং ওয়াশিংটনে ঋণসীমা বৃদ্ধি এই সমসাময়িক ঘটনাগুলোর কারণে ডলারের উপর চাপ পড়ছে।এই প্রবাহমান চাপের কারণে ডলার নিজের অবস্থান কতটুকু ধরে রাখতে পারবে এটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির কাছে ডলারের রিজার্ভ নামে একটি কোষাগার রয়েছে যা তারা কঠিন সময়ে সাহায্য করার জন্য রাখে। যখন একটি দেশের অর্থের মূল্য কম হয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের অর্থকে আবার শক্তিশালী করতে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু দেশের টাকা ডলারের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়লে তা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এটি বিশেষভাবে সত্য যখন দেশগুলিকে ডলার ব্যবহার করে জ্বালানির মতো জিনিস কিনতে হয়। যখন ডলারের মূল্য অনেক বেড়ে যায়, তখন জিনিস কেনার জন্য এটি আরও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে, যার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে। হংকং, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের মতো অনেক দেশে টাকা আমেরিকান ডলারের তুলনায় অনেক কম। এটা এমন যে আপনার যদি ১০ ডলার থাকে এবং হঠাৎ করে সেই দেশগুলিতে এটি শুধুমাত্র $৫ হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ভিন্ন কোন মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই ধারণাটিই হল ডি-ডলারাইজেশন।চীনকে কেন্দ্র করে ডি ডলারাইজেশন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮৪ দশমিক ৩ শতাংশই হচ্ছে ডলারে; মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হয় চীনের মুদ্রা ইউয়ানে। চীন,ভারত এবং ব্রাজিল এর মতো বড়ো বড়ো বেশ কিছু উদীয়মান অর্থনীতি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের লেনদেনে ইতিমধ্যে ডলারের বিকল্প মুদ্রার ব্যবহার শুরু করেছে।
গত মার্চে ভারতের নয়াদিল্লিতে একটি বড় বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকটি ছিল ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার বিষয়ে। তারা হয়তো ডলারের বদলে নতুন টাকা ব্যবহার করার কথা বলেছে।আগস্টে আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন নামে একটি বৈঠক হয়েছে। BRICS হল ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সহ দেশগুলির একটি গ্রুপ। তারা একে অপরের সাথে বাণিজ্য করার সময় ডলারের পরিবর্তে একটি ভিন্ন ধরনের অর্থ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা রুবেল, রুপি এবং রেনমিনবি ইউয়ানের ডিজিটাল সংস্করণ ব্যবহার করার কথা বলছে। অন্যদিকে ব্রিকস জোটে চীন সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। স্বাভাবিকভাবে চীন সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করবে। এতে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্যঘাটতি বাড়বে। সেটা নিয়ে আবার তাদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রার বাস্কেট হল বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের অর্থের একটি দল। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, জাপান এবং চীন থেকে আসা অর্থ। এশিয়ান দেশগুলোর একে অপরের সাথে বাণিজ্যের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে যাকে বলা হয় এশিয়ান ক্লিয়ারিং সিস্টেম। এই ব্যবস্থায়, মার্কিন ডলার একটি মধ্যস্থতাকারী মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তবে দেশগুলি চাইলে তাদের নিজস্ব অর্থ ব্যবহার করতে পারে। চীন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের মধ্যে অর্থ পাঠানোর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাও তৈরি করেছে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে। বেশিরভাগ দেশ তাদের অর্থ মার্কিন ডলারে রাখে, তবে কিছু দেশ ইউরো এবং অন্যান্য মুদ্রায়ও রাখে। চীনা ইউয়ানে সামান্য পরিমাণই রাখা হয়।
বাংলাদেশ এখন অন্য দেশের সাথে জিনিস কেনা-বেচায় ইউরো ব্যবহার করছে। কিন্তু তাদের কাছে আগের মতো সঞ্চিত টাকা নেই, তাদের কাছে আছে মাত্র ৩১ বিলিয়ন ডলার। কিছু নিয়মের কারণে, তারা রাশিয়ার পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। রাশিয়া অর্থ পরিশোধের জন্য ভিন্ন উপায়ের প্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ বিপাকে পড়ে চিন্তিত।
তাই রাশিয়া এখন চাইছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণের কিস্তি ২১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বাংলাদেশ যেন তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পরিশোধ করে। আর এটা করতে হলে বাংলাদেশকে ডলারই গুণতে হবে।
বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে রুবলে লেনদেন করছে না কেন?
কারণ “রুবলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। বাংলাদেশের সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার সামর্থ্য নাই। রুবলে লেনদেন করলে বাংলাদেশও নিষেধাজ্ঞায় পড়ে যেতে পারে। কিন্তু ভারতের সেই চাপ সামলানোর ক্ষমতা আছে। তারা বিশ্বে প্রভাবশালী। রুবলে লেনদেন করায় ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন যাচ্ছে। তারপরও তাদের সেটা উপেক্ষা করার সক্ষমতা আছে।”
অর্থাৎ বলা যায় যে, ডি-ডলারাইজেশন এর জন্যে সকল দেশকে মুদ্রার বিষয়ে ঐক্যমত্যের পৌঁছাতে হবে।