বাংলা সাহিত্যের নন্দিত কিংবদন্তি কবি যিনি বিংশ শতাব্দী জুড়ে বাংলাদেশের সকল মানুষ এঁর মনে প্রাণে মিশে ছিলেন তিনি -হুমায়ূন আহমেদ! বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে হুমায়ুন আহমেদকে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিক থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত, তিনি ছিলেন বাংলা আখ্যান উপন্যাসের অন্যতম একজন জনপ্রিয় লেখক। তবে তার জনপ্রিয়তা এখনো বেশ জোরালো। ঔপন্যাসিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি নাটক, ছোটগল্প, চলচ্চিত্র এবং গান রচনা করেছেন। এছাড়াও, তার কৃতিত্বের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বইও রয়েছে। তিনি তার প্রতিটি রচনায় মধ্যবিত্ত জীবনের ধারাবাহিক কাহিনী এমন সরলতার সাথে তুলে ধরেছেন যে তা পাঠকদের বিমোহিত করতে বাধ্য। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তাঁর লেখার অসংখ্য অনুবাদ পাঠ্যপুস্তকে তৈরি করা হয়েছে। তাঁর রচিত ২০০ টিরও বেশি বই রয়েছে এবং এঁর মধ্যে নন্দিত নরকে অন্যতম একটি উপন্যাসের উপাখ্যান।
উপন্যাসটি খুব সাধারণ একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের জীবন সংগ্রাম নিয়ে লেখা, যে পরিবারেরই মানসিক বিকারগ্রস্ত মেয়ে রাবেয়া। রাবেয়াকে ঘিরেই পুরো গল্পের পটভূমি।এছাড়াও এই গল্পে শফিক, তার ভাই, বোন, মা, বাবা সহ আরও অনেক লোক রয়েছে।
তার এক বছরের ছোট খোকা যে কিনা মাস্টার্স পরীক্ষার্থী, এর পর বেখেয়ালী স্বভাবের মন্টু, যে রাবেয়ার বাবার প্রথম বউ এর ছেলে আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে রুনু। তাদের সাথে রয়েছে শফিক, যিনি তাদের বাবার একজন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত বন্ধু , তারা মোট ছয়জনের পরিবার নিয়ে থাকেন। তাছাড়াও শফিক সাহেব একজন শিক্ষক এবং এঁর পাশাপাশি তিনি রাবেয়ার ভাইবোন দেরও পড়ান।
লেখক বইটিতে শিলু এবং তার ভাই হারুনের কথাও উল্লেখ করেছেন, যারা পাশের বাড়ির ধনী পরিবার গুলোর মধ্যে একটি। শিলুকে নিয়ে আছে খোকার মনে চাপাপড়া আবেগের ঘটা আর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী রাবেয়ার প্রতি হারুনের রয়েছে দূর্বলতা , যা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে একটি নিছক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।একটি পরিবারের দুঃখ ও কষ্টের এক বিষাদের বর্ননা রয়েছে এই উপন্যাসে।
হঠাৎ চৈত্রের এক বিকেলে রাবেয়া উধাও! অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাস্টার চাচা তাকে খুঁজে পেয়ে তার বাড়িতে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর রাবিয়ার শারীরিক পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে গেল! তখন তার মা শাহানা বুঝতে পেরেছিলেন যে, রাবেয়া সন্তান সম্ভবা। তবে মা ও ভাইয়ের শত প্রশ্ন করা সত্ত্বেও মানসিকভাবে অসুস্থ রাবেয়া ছিলেন চুপ! এরপর তার বাবা রাবেয়াকে বিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। একদিন সকালে, সামাজিক অসম্মানের ভয়ে রাবেয়াকে তার নিজের বাড়িতে গোপনে গর্ভপাত করা হয়। কিন্তু খুব বেশি রক্তক্ষরণ রাবেয়ার প্রাণ কেড়ে নিল!
এই ঘটনায় মন্টু , মাস্টার কাকাকে দায়ী করে এবং বাড়ি ভর্তি লোকজনের সামনেই তাকে ধারালো বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে। পুলিশ মন্টুকে ধরে নিয়ে যায় আর ঠান্ডা মাথায় মাস্টারকে খুন করার অপরাধে তার ফাঁসির রায় হয়ে যায়।
যদিও পাঠকরা গল্পটি পড়ে বা মাস্টার কাকার উপর মন্টুরের আক্রমণ থেকে এই উপসংহারে আসবে যে মাস্টারই রাবেয়াকে ধ্বংস করেছিলেন, তবে লেখক গল্পে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি যে রাবেয়া কার লালসা স্বীকার করেছিল। লেখক অত্যন্ত করুণ ভঙ্গিতে উপন্যাসের শেষ অংশটি তুলে ধরেছেন।
জেল গেটে একজন দুঃখ-শোকে কাতর বাবা আর অসহায় এক ভাই ভোর রাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে তাদের প্রিয় মন্টুর মৃতদেহের অপেক্ষায়!
রাবেয়ার ভয়ঙ্কর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্পের লেখক তুলে ধরেছেন বহির্বিশ্বে নারীরা কতটা অনিরাপদ। সবকিছু বিবেচনায় নিলে, “নন্দিত নরকে” নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সেরা সৃষ্টি। সহজভাবে বললে সেরা একটি উপন্যাস!