বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৫
29 C
Dhaka

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন কি সত্যিই মিসলিডিং?

spot_img

ভিডিও

- Advertisement -

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা ও অবমাননাকর’ দাবি করেছিল বিগত সরকার। বলা হয়, লন্ডন ও অন্যান্য জায়গায় সক্রিয় উগ্রপন্থী ও তাদের সহযোগীদের উসকানিতে বেপরোয়া ও নোংরা অপপ্রচার চালাচ্ছে আল-জাজিরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, এই প্রতিবেদন একগুচ্ছ বিভ্রান্তিকর শ্লেষ আর বক্রোক্তি ছাড়া কিছুই নয়। (বাসস, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১)।

একইভাবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার, অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট, নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস করে নাগরিকের ভোটাধিকার হরণসহ নানা ইস্যুতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠানের বিবৃতি ও প্রতিবেদনও সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের তরফে সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করা হতো।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো দলীয় সরকার না হলেও এবং একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একজন নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে এই সরকারটি গঠিত হলেও তারাও বিগত সরকারগুলোর সেই ‘কালচার অব ডিনায়াল’ বা ‘নাকচের সংস্কৃতি’ থেকে বের হতে পারেনি। দেশি-বিদেশি যেকোনো গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনামূলক যেকোনো প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণকে আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে এই সরকারের মধ্যেও অভিযোগ অস্বীকার তথা প্রতিবেদনকে নাকচ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি খবরের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এটিকে ‘মিসলিডিং’ বা বিভ্রান্তিকর বলে দাবি করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এই প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে এবং এ নিয়ে সমালোচনার মূল কারণগুলো কী কী? প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে বা যেসব ফ্যাক্ট বলা হয়েছে, সেগুলো কি অবাস্তব? এরকম প্রতিবেদনের বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ বা প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত?

গত পয়লা এপ্রিল প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত As Bangladesh Reinvents Itself, Islamist Hard-Liners See an Opening শিরোনামে ওই খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্র পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশের সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের জন্য নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছে, তখন দীর্ঘদিন ধরে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ (সেক্যুলার) চেহারার নিচে চাপা পড়ে থাকা ইসলামী কট্টরপন্থী প্রবণতা সামনে চলে আসছে। বিশেষ করে নারীদের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের অবস্থানের জানান দিতে শুরু করে তারা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতায় ধর্মীয় মৌলবাদীরা বিভিন্ন শহরে নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে শুরু করেছে। প্রকাশ্য নারীকে হেনস্থাকারীকে ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় এক সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছে যে, ইসলাম অবমাননার অভিযোগে যদি সরকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে, তবে তারা নিজেরাই বিচার করবে। এর কয়েকদিন পর একটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠী (হিযবুত তাহরীরা) ইসলামী খেলাফতের দাবিতে বিশাল মিছিল বের করে। বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে এই প্রতিবেদনকে ‘মিসলিডিং’ বা বিভ্রান্তিকর বলে  আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে সরলভাবে দেখা হয়েছে। বাছাইকৃত কিছু ঘটনা তুলে ধরে ভ্রান্ত ধারণা ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশে যখন কিছু কট্টরপন্থী ইসলামিক গ্রুপের তৎপরতা বাড়লো; কোনো কোনো গোষ্ঠীর তরফে এখানে শরিয়া আইন চালু; নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেয়া; গানের অনুষ্ঠান বন্ধ করা; অসংখ্য মাজার ভাঙা; মহানবীর (স.) কটূক্তির অভিযোগে খুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একজন হিন্দু তরুণকে গণপিটুনি দিয়ে প্রায় মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটতে থাকলো; হিযবুত তাহরীরের মতো একটি নিষিদ্ধঘোষিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন যখন প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা বাড়াতে থাকলো—সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই সতর্ক করেছিলেন যে, সরকার যদি এসব তৎপরতা কঠোরভাবে দমন না করে এবং যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এদেরকে মদদ দেয় কিংবা এদেরকে যদি সমীহ করে, ভয় পায়—তাহলে দেশের বাইরে খুবই খারাপ বার্তা যাবে যে, বাংলাদেশে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটছে। বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এইসব ঘটনার সুযোগ নেবে।

বাস্তবতা হলো, কট্টর ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ শুরু থেকেই নমনীয়। হয় তারা এদেরকে ভয় পায় অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার কারণে নানাবিধ উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। অথবা জুলাই অভ্যু্ত্থানে এসব দল ও গোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বলে সরকার এদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারছে না। ঘটনা যা-ই হোক না কেন, ৫ আগস্টের পর থেকে যে এখানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দিয়েছে, সেটি নিউইয়র্ক টাইমস লিখুক বা না লিখুক, দেশের মানুষই সাক্ষী।

তাছাড়া নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সেসব ঘটনা নিয়ে দেশের গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। এটি হচ্ছে মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ হলো সরকার এসব ঘটনায় কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে—সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।

৫ আগস্টের পরে অব্যাহতভাবে মাজার ভাঙা, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি৩২ নম্বরের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া বা সারা দেশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনা প্রতিহত করতে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধের বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার তরফে বিবৃতি এসেছে। যারা এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও একাধিকবার মবের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ‘তৌহিদী জনতা’র নামে যারা নানারকম উগ্রবাদী  কর্মকাণ্ড করেছেন, তাদেরকে সাবধান করেছেন। যদিও কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা আইনের আওতায় আনা হয়েছে—তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আনীত অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং তথ্য উপদেষ্টা একই ভাষায় বলেছেন যে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদের স্থান হবে না। ফলে সরকারের তরফে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আসা তথা উগ্রবাদীদের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন না দেয়াটাও ইতিবাচক।

অস্বীকার করা যাবে না, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রকাঠামোয় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, অনেক সময় তৃতীয় পক্ষ তা সুযোগ নেয়। তারা তখন নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের উত্তম সুযোগ বলে মনে করে। বাংলাদেশেও গত কয়েক মাস ধরে যা ঘটছে, সেটি মূলত তারই ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে হিযবুত তাহরীর বা এরকম কট্টরপন্থী দল ও সংগঠগুলোর তৎপরতা যে বেড়েছে, সেটি অস্বীকার করার সুযো‍গ নেই। পক্ষান্তরে সরকার যে এসব সংগঠনের তৎপরতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না বা সমর্থন করছে না—সেটিও স্বীকার করা উচিত।

শুরুর দিকে সরকার এসব সংগঠন বা কথিত তৌহিদী জনতার বিরুদ্ধে খুব বেশি কঠোর অবস্থা যেতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে ভয় ও হতাশার কারণে। সেনাবাহিনীও হয়তো সচেতনভাবেই যতটা কম কঠোর হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়, সেই চেষ্টা করেছে। কিন্তু গত ৭ মার্চ হিযবুত তাহরীরের মার্চ ফর খেলাফত কর্মসূচি ঠিকই কঠোরভাবে প্রতিহত করেছে।

সব মিলিয়ে সরকার শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যতটা নমনীয় ছিল বা নমনীয় থাকতে বাধ্য হচ্ছিলো, এখন পরিস্থিতি সেরকম নেই। নেই বলেই ধর্মীয় উগ্রবাদী ও কট্টরপন্থী এবং কথিত তৌহিদী জনতার আস্ফালন কমে এসেছে। কারণ তারাও হয়তো এরইমধ্যে বুঝে গেছে যে, সরকার তাদের এসব কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় দেবে না। কারণ সরকার যদি এসব কর্মকাণ্ডে মৌন সমর্থনও দেয়, তাহলেও সারা বিশ্বে একটি ভুল বার্তা যাবে এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্রবাদের বিস্তার ঘটছে—এই অভিযোগের দায় ড. ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ নিজের কাঁধে নেবেন না।

সুতরাং, দেশি-বিদেশি যেকোনো গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনামূলক প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ প্রকাশিত হলে অতীতের সরকারগুলোর মতো সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেয়া বা অভিযোগ অস্বীকারের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে অভিযোগগুলোর ব্যাপারে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা এবং কোনো রিপোর্টকে ‘মিসলিডিং’ বলে আখ্যা দিতে হলে সুনির্দিষ্টভাবে তারও ব্যাখ্যা দেয়া উচিত যে, ঠিক কী কী কারণে এটি বিভ্রান্তিকর। তার চেয়ে বড় কথা মানুষের পারসেপশন। বিদেশি গণমাধ্যম কী লিখলো বা কী দেখালো, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের মানুষ পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছে এবং সরকারের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী—সেটিও সরকারকে নির্মোহভাবে উপলব্ধি করতে হবে।

আমীন আল রশীদ
সাংবাদিক ও লেখক

- Advertisement -
spot_img

আলোচিত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ

ভিডিও