অমর্ত্য সেন একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক এবং দার্শনিক। তিনি দরিদ্র ও অপুষ্টদের কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত এবং সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের সমস্যা সমাধানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। খাদ্য ঘাটতি ও অনাহার রোধে বাস্তব সমাধান তৈরিতে তার অবদান অনস্বীকার্য। নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘বিশ্বের ৫০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি’ তালিকায় স্থান দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন নিজেকে ঢাকা এবং কলকাতা দুই শহরেরই সন্তান হিসাবে গণ্য করেন। অমর্ত্য সেন নোবেল ওয়েবসাইটে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে, আমার জন্ম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এবং সারা জীবনই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে। আমার পৈত্রিক বাড়ি হচ্ছে পুরানো ঢাকার ওয়ারি অঞ্চলে- রমনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছেই। আমার বাবা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি পড়াতেন। আমার জন্ম অবশ্য শান্তিনিকেতনে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে। আমার মাতামহ সেখানে অধ্যাপক ছিলেন,” নোবেল ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন অমর্ত্য সেন।
সূচনা
জন্ম
শিক্ষা
কর্মজীবন
ব্যক্তিজীবন
পুরস্কার ও সম্মাননার এক অমিতাভ বর্ণমালা
অর্থনীতিতে অবদান
গ্রন্থাবলী
অমর্ত্য সেন এর জীবন এক নজরে | |
জন্ম: ৩নভেম্বর, ১৯৩৩, শান্তিনিকেতন, ব্রিটিশ ভারতপিতাঃ আশুতোষ সেনমাতা: অমিতা সেনপিতামহ: ক্ষিতিমোহন সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সহযোগীনামকরণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক পুরস্কার ও সম্মাননা: নোবেল স্মারক পুরস্কার (১৯৯৮)ভারতরত্ন (১৯৯৯)ন্যাশনাল হিউম্যানিটিস মেডেল (২০১২)বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরস্কার (২০১৮) প্রকাশিত বই: -Poverty and Famines (১৯৮১)-The Choice of Techniques (১৯৬০)-Collective Choice and Social Welfare (১৯৭০)-On Ethics and Economics (১৯৮৭)-Identity and Violence: The Illusion of Destiny’ (২০০৬)-Home in the World: A Memoir’ (২০১১) | শিক্ষা: প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতাট্রিনিটি কলেজ, কেমব্রিজদিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্স কর্মজীবন: অধ্যাপক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়‘মাস্টার‘: ট্রিনিটি কলেজ, কেমব্রিজনোবেল পুরস্কার: ১৯৯৮, অর্থনীতিতেমানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index – HDI): উদ্ভাবক |
জন্ম:
১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর শান্তিনিকেতনের পবিত্র মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন। একটি সম্ভ্রান্ত বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ আশুতোষ সেন এবং লেখিকা ও সমাজকর্মী অমিতা সেনের সন্তান অমর্ত্য সেন ছোটবেলা থেকেই জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে “অমর্ত্য” নাম দিয়েছিলেন, যার অর্থ “অমর” বা “অবিনশ্বর”।
শিক্ষা:
অমর্ত্য সেনের মায়ের দাদু ছিলেন একজন শিক্ষক এবং তার মা ছিলেন একজন শিক্ষার্থী। অমর্ত্য সেন একই স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন এবং শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগে তিনি ঢাকায় সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা করেন । সেখান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে তিনি জ্ঞানের জগতে নিজের আসন স্থাপন করেন।
ব্যাক্তিগত জীবন:
অমর্ত্য সেন বিয়ে করেছিলেন তিনবার। নবনীতা দেব সেন তার প্রথম স্ত্রী, যিনি একজন লেখিকা। তাদের দুই মেয়ে, একজন অন্তরা পেশায় একজন সাংবাদিক ও প্রকাশক। আরেকজন নন্দনা; যিন একজন অভিনেত্রী। ১৯৭১ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তারপর অমর্ত্য সেন ইতালীয় অর্থনীতিবিদ ইভা কলোর্নি নামে একজন ভদ্র মহিলাকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান – কবির এবং ইন্দ্রাণী। কিন্তু ১৯৮৫ সালে ইভা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর ১৯৯১ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমা রথচাইল্ডকে বিয়ে করেন অমর্ত্য সেন।
কর্মজীবন:
অমর্ত্য সেন, নামটি শুধু একজন অর্থনীতিবিদের পরিচয় বহন করে না, বরং একজন দার্শনিক, লেখক এবং মানবতাবাদীর প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাঁর জীবনী এক অনবদ্য আখ্যান, যেখানে প্রতিভা, জ্ঞানপিপাসা এবং মানবকল্যাণের প্রতি নিরন্তর আগ্রহ এক অপূর্ব মিশেল তৈরি করেছে।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে অমর্ত্য সেন জ্ঞানের জগতে ঝড় তোলেন। এরপর তিনি ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলেতে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত।
লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার মাধ্যমে অমর্ত্য সেন বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লেখা ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যার মাধ্যমে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছে বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের মন।
অমর্ত্য সেনের জ্ঞানের পরিধি শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো বিষয়ে তাঁর গভীর চিন্তা-ভাবনা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ১৯৯৮ সালে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল স্মারক পুরস্কার লাভ করেন।
অমর্ত্য সেন একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, যাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং মানবিকতা বিশ্ববাসীকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তাঁর জীবনী এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, যা প্রতিটি নতুন প্রজন্মকে জ্ঞানের আলোয় এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে।
পুরস্কার ও সম্মাননারঃ
অমর্ত্য সেন ১০২টি সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার জ্ঞান ও কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ, অমর্ত্য সেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননার তালিকা:
- ১৯৫৪: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি দ্বারা অ্যাডাম স্মিথ পুরস্কার।
- ১৯৫৬: কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিভেনসেন পুরস্কার।
- ১৯৭৬: মহলনোবিস পুরস্কার।
- ১৯৮৬: রাজনৈতিক অর্থনীতিতে র্যাঙ্ক ই. সিডম্যান ডিস্টিংগুইশড অ্যাওয়ার্ড।
- ১৯৯০: সিনেটর জিওভানি অ্যাগনেলি নৈতিকতার আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
- ১৯৯০: অ্যালান শন ফেইনস্টিন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার অ্যাওয়ার্ড।
- ১৯৯৩: জিন মেয়ার গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড।
- ১৯৯৪: এশিয়াটিক সোসাইটির ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণপদক পুরস্কার।
- ১৯৯৭: এডিনবার্গ পদক।
- ১৯৯৭: নবম কাতালোনিয়া আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
- ১৯৯৮: অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার।
- ১৯৯৯: ভারতরত্ন পুরস্কার।
- ১৯৯৯: বাংলাদেশ সরকার থেকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব।
- ২০০০: গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে লিওনটেফ পুরস্কার।
- ২০০০: নেতৃত্ব ও সেবার জন্য আইজেনহাওয়ার পদক USA.
- ২০০০: কম্প্যানিয়ন অফ অনার।
- ২০০২: ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিক্যাল ইউনিয়ন থেকে আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী পুরস্কার।
- ২০০৩: ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স তাকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।
- ২০০৩: UNESCAP থেকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড।
অর্থনীতিতে অবদান:
অমর্ত্য সেন অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর গবেষণা দরিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, নারীর ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো জটিল বিষয়গুলোকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
- দুঃখকষ্ট দূরীকরণ: অমর্ত্য সেন দুঃখকষ্টের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি শুধু আয়ের অভাবকে দুঃখকষ্টের কারণ হিসেবে দেখেননি, বরং ব্যক্তির সামর্থ্য হারানোকেও এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
- দরিদ্রদের আয়ের প্রতিস্থাপন: অমর্ত্য সেন দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দরিদ্রদের আয়ের প্রতিস্থাপন করার জন্য বিভিন্ন নীতি প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন।
- সামর্থ্য ধারণা: অমর্ত্য সেন “কির সমতা” প্রবন্ধে ‘সামর্থ্য’ ধারণাটি চালু করেছিলেন। তিনি মনে করেন, সমতা কেবল আয়ের সমতা নয়, বরং ব্যক্তির সামর্থ্যের সমতাও।
অমর্ত্য সেনের প্রধান গ্রন্থাবলী
- সামগ্রিক আগ্রহ এবং সামাজিক উন্নয়ন (১৯৭০)
- অর্থনীতিতে অসমতা (১৯৭৩)
- দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ (১৯৮২)
- আগ্রহ, উন্নয়ন ও পরিমাপ (১৯৮২)
- খাদ্য অর্থনীতি ও অধিকার অর্জন (১৯৮৬)
- নীতিশাস্ত্র ও অর্থনীতি (১৯৮৭)
- ক্ষুধার্ত এবং জনতার প্রতিক্রিয়া (১৯৮৯)
- ১০ কোটির অধিক নারীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না (১৯৯০)
- অসমতার পুনঃপরীক্ষণ (১৯৯২)
- জীবনের গুণাগুন (১৯৯৩)
- পরিচয়ের পূর্বে কারণ (১৯৯৮)
- উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা (১৯৯৯)
- যৌক্তিকতা ও স্বাধীনতা (২০০২)
- তর্কপ্রিয় ভারতীয় (২০০৫)
- পরিচয় এবং সহিংসতা (২০০৬)
- জগৎ কুঠির (২০২২)