খেলাধুলার টিমগুলো কখনো কখনো হয়ত আয়নার মতো, যেটাতে উকি দিলে কোন দেশ কিংবা জাতির বৈশিষ্ট্য কেমন, ভেসে ওঠে সেই প্রতিচ্ছবি। শুধু চাই দেখার মতো একটা চোখ। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে যেমন পাওয়া যায় ব্রাজিলিয়ান ঘরানায় জীবনটাকে আবহমানকাল ধারে উপভোগের নন্দন, জোগো বনিতো; জার্মান ফুটবলে তেমনি ভেসে ওঠে জার্মান জাতির তীব্র জাত্যাভিমান, মানসিক দৃঢ়তা। ক্রিকেটের পৃথিবীতে পাকিস্তান ঠিক তেমনই একটা দল, যেটা সামনে নিয়ে আসে পাকিস্তানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্র, ঐক্যের ঘাটতি, লাগাতার চলা আঞ্চলিকতার রাজনীতি, আনপ্রেডিকটিবিলিটি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে যে নতুন একটা দেশের জন্ম হয়েছিল, তার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল ১৯৫২ সালে, পাকিস্তানের মূলধারাকে নিয়ন্ত্রণ করা উর্দুভাষিদের সাথে বাংলায় কথা বলাদের দূরত্বে। দুটা দেশ আলাদা হয়েছে, এখন সময় অনেক দূর পেরিয়েছে, তবু করাচিকেন্দ্রিক উর্দুতে কথা বলাদের চরিত্র আজও বদলায়নি। যেটার প্রভাব সবসময়ই ছিল, আছে এমনকি পাকিস্তান ক্রিকেট টিমেও। বর্তমান অধিনায়ক বাবর আজম লাহোর থেকে উঠে আসা একজন পাঞ্জাবি। করাচি কেন্দ্রিক প্রশাসক, গণমাধ্যম সেখানকার ক্রিকেটে অত্যন্ত প্রভাবশালী; তার সবসময় চায় উর্দুভাষী কারো কাছে থাকুক আর সবকিছুর মতো পাকিস্তান ক্রিকেট টিমেরও নেতৃত্ব। এরকম একটা ন্যারেটিভ মোটেও যে মিথ্যে নয়, সেই ছাপ পাওয়া যাবে ডমেস্টিক ক্রিকেট কালচারেও, সেখানকার ব্যাট বলের খেলার রুট লেভেলে কান পাতলেই শোনা যায় লাহোর বনাম করাচি দ্বন্দ্ব।
ন্যাশনাল টিমের ক্রিকেটারদের, দীর্ঘসময় ধরে এই আঞ্চলিকতার বিভাজনের বাইরে থাকার সুযোগ খুব কমই। যদি খেলোয়াড়রা ঐক্যবদ্ধ্বও থাকে, সেটা বেশি দিন থাকে না। প্রায়ই দেখা যায় অঞ্চলভিত্তিক প্রশাসক-গণমাধ্যমগুলো কাজ করে থাকে তাদের কাঙ্ক্ষিত আঞ্চলিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে। তাই পাকিস্তান দলের অধিনায়ক হওয়ার সম্ভবত সবচাইতে কঠিন এবং ব্যাপকভাবে অনিশ্চিত এক যাত্রা। কারণে এতো ঘন ঘন ক্যাপটেনসি বদল হয় সেখানে। উদাহরণস্বরূপ সাম্প্রতিক রেফারেন্সেই যদি টানা হয়, বাবর আজমকে বদলে শাহীন শাহ আফ্রিদিকে দেওয়া হয়েছিল কাপ্তানি, মাত্র ৪ মাস বাদেই আবার তাকে বাদ দিয়ে অধিনায়কত্বের চেয়ারে ফিরিয়ে আনা হয় বাবর আজমকে। এই দুজন কেবল টিম মেট নন, অত্যন্ত ভালো বন্ধুও ছিলেন। তবে সাম্প্রতিকে যে ধরনের নাটকীয় পালাবদল হয়েছে, তাতে করে সম্পর্কটা আর আগের জায়গায় নেই, এমনটা বলছে সেখানকার মিডিয়াগুলো। টিপিক্যাল পাকিস্তান আর পাকিস্তান ক্রিকেট টিম বোধহয় একেই বলে, এখানে কেউ কাউকে চাইলেও বিশ্বাস করতে পারে না, মোদ্দা কথা বিভক্তি-বিভাজন, ষড়যন্ত্রের তীর্থস্থান।
যদি প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের কথা বলা হয়, ব্যাটিংয়ে স্ট্যাটিসক্যালি অন্যতম দুই বিশ্বসেরা বাবর আজম-মোহাম্মদ রিজওয়ান; বোলিংয়ে শাহীন শাহ আফ্রিদি-হারিস রউফ-নাসিম শাহ-মোহাম্মদ আমির। সম্ভবত বিশ্ব ক্রিকেটের সবচাইতে দুর্ধর্ষ বোলিং অ্যাটাক। কিন্তু সর্বদা চলমান নানান রকম রাজনীতি-মেরুকর। পাকিস্তানে প্রতিভা-সামর্থ্যকে ঠিক কখনোই ফুল হয়ে কখনোই ফুটতে পারে না, ধারাবাহিকভাবে। পাকিস্তান টিমটার ট্যালেন্ট-এবিলিটির সীমাবদ্ধতা হয়তো সেই সীমাবদ্ধতার মতো।
আপনি পকেটে অনেকগুলো হীরের টুকরো নিয়ে ঘুরছেন, কিন্তু সেগুলো ঠিক জায়গায়-ঠিক দামে বিক্রি করতে চাইলেও পারছেন না! এমনি এমনি তো আর চাঁদ তারার টিমকে বলা হয় না, ক্রিকেটের সবচাইতে আনপ্রেডিকটেবল টিম! যুক্তরাষ্ট্রের মতো নবাগত টিমের কাছে বাবর আজমরা হারতে পারে, আবার ভয়ংকর সেই বাজে শুরুর পর, বিশ্বকাপ জিতেও নিতে পারে, ওদের ক্রিকেট ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্ত যথেষ্ট আছে। পাকিস্তান ক্রিকেট টিমটা এমনই। পাকিস্তান দলটা সম্ভবত টম হ্যাংকসের বিশ্ববিখ্যাত সিনেমা forrest gump এর অনবদ্য সেই ডায়ালগের মতো “Life is like a box of chocolates! You never know what you gonna get!”