ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ আন্দোলন বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার ভিত্তি সুদৃঢ় করে। দ্বিজাতিতত্ত্বই যদি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র যৌক্তিকতা হয়, তাহলে সে রাষ্ট্রের সূচনাতেই ভাষা বিতর্ক দেখা দেবে কেন ? বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিসের পরিচায়ক? এসব প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি এ অধ্যায়ে ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি, এর বিভিন্ন পর্ব বা পর্যায়, বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে।
পাকিস্তান-পূর্ব ভাষা বিতর্ক
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে প্রশ্নে এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংঘটিত হয়। তবে হঠাৎ করে এ অবস্থার সৃষ্টি হয় নি। পাকিস্তান সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকে উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাষাবিতর্ক দেখা দেয়। ১৯০৬ সালে ঢাকায় যে সময়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তার ৩ দিন পূর্বে একই স্থানে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল সম্মেলনে এ প্রশ্ন ওঠে। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাঙালি প্রতিনিধিদের বিরোধিতার কারণে সেদিনকার সে উদ্যোগ সফল হয় নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বাহে ভাষাবিতর্ক আরও স্পষ্ট রূপ নেয়। ১৯৪৭ সালের মে মাসে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত এক উর্দু সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান ঘোষণা করেন, ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা’। জুলাই মাসে (১৯৪৭) আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুর পক্ষে একইরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। একই সময় ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ Ôআমাদের ভাষা সমস্যা’ শিরোনামে লেখা এক প্রবন্ধে ড. জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য খণ্ডন করে বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যে উর্দুকে নতুন রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী, তা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই স্পষ্টত ধারণা করা যাচ্ছিল। ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ও তাঁর অনুসারীরা এ সম্বন্ধে বাঙালিদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
ভাষাবিতর্ক নিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। তবে ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। পাকিস্তান রাষ্ট্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগের বিরোধিতা করে বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে গড়ে ওঠা বাঙালিদের যে আন্দোলন, তা-ই ভাষা আন্দোলন।
ভাষা আন্দোলনকে দুটি পর্বে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্ব ১৯৪৭-৪৮। এ সময়ে ভাষার প্রশ্ন বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা প্রতিবাদ-বিক্ষোতে রূপ নেয়। জিন্নাহর ঢাকা ঘোষণা এবং এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদ ছিল মুখ্য ঘটনা। দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্ব হচ্ছে ১৯৫২ সাল। এ সময়ে সংঘটিত হয় অমর একুশে ফেব্রুয়ারি।