শনিবার, জুন ১০, ২০২৩

পূর্বপাকিস্তান (বাংলাদেশ) নিরাপত্তা সার্ভিস ও মার্কিন জননিরাপত্তা দফতর

- Advertisement -
- Advertisement -

১৯৫০ সালের গোড়া থেকে ১৯৭৩—এর শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডি সি এলাকায় CIA International Police Service নামে একটা প্রতিষ্ঠান চালাতো। সংস্থাটির দুটো কাজ ছিলোঃ মিত্রদেশগুলোর আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা এবং বিদেশী শিক্ষার্থীদে মধ্যে মার্কিনপহ্নী মনোভাব গড়ে তোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা। দ্বিতীয় কাজটি করতে পারলে CIA’র পরে এদের গোয়েন্দা তথ্যের আকর হিসেবে নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়ে নেবার পরিকল্পনা ছিলো। ৬০ দশকের গোড়ার Agency for International Development—এরঃ Office of Public Safety (AID/OPS) বা জননিরাপত্তা সংস্থা বিদেশী পুলিশ প্রশিক্ষণে সক্রিয় ভাব জড়িত হয়ে পড়লো … CIA’র দলিলপত্র হতে আভাস পাওয়া যায় যে  OPS এর সহযোগিতায় সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ OPS ও IPS ছাত্রদের তালিকা CIA ‘র অঙ্গ সংস্থাগুলারে কাছে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হতো ।”

(House Select Committee of Intelligence, The Pike Committee Report ,19 January 1976)

“সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল নাজিমুদ্দিন দীর্ঘ এবং উত্তপ্ত বির্তকে চলে গেলেন। তিনি মোটের উপর যা বললেন তা হলো…বেশ ক’জন অংশগ্রহণকারী বলছিলেন যে CIAই IPA চালায়। তিনি অবশ্য এসমস্ত গুজব কখনােই আমল দেননি কিন্তু এখন তাঁর নিজের মনেও সন্দেহ দেখা দিচ্ছে… IPA—তে ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে এত হৈ চৈ দেখে মনে হচ্ছে যে অংশগ্রহণকারীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটা উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে ও তাঁদের বিবেক দখল করে নেবার জন্য…” ।

(Confidential OPS memorandum, 24 May 1971, Subject t Assistant Inspector General Dilshad Najmuddin , From t A Bonnefil,Chief, Participant Relations Section, International Police Academy, Washington)

“স্কুলটি (INPOLSE) (আন্তর্জাতিক) পুলিশ একাডেমীর একটি সমান্তরাল সংস্থা হিসেবে কাজ করে। বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষক IPA’কে একটা ‘স্নাতকোত্তর’ স্কুল হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ফিলিপ এজি বলেছেন যেসব CIA প্রশিক্ষকদের পুলিশ একাডেমীতে রাখলে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে, তাদের আড়াল করার জন্য INPOLSE ব্যবহার করা হয়।

(John Marks and Taylor Branch, Harper’s, Weekly,”Reports on INPOLSE’’)

মিঃ ফ্রেসারঃ  আচ্ছা, CIA’র বিদেশী তৎপরতায় OPS মিশনগুলো কি কখনো ব্যবহৃত হয়েছে ? CIA—র কোন লোক কি কখনো বাইরে OPS মিশনে কাজ করেছেন ?

মিঃ পার্কারঃ  জ্বি, AID/OPS —এর সাথে CIA মিশনগুলোর একটা সহযোগিতামূলক বন্দোবস্ত আছে। এ সম্বন্ধে বিশদ জানতে চাইলে সেই সংস্থাকেই (CIA) জিজ্ঞেস করতে হবে …” (House Foreign Affairs Committee Hearing, June 1974,Donald Fraser, Chairman; Daniel Parker, Director, AID)

“সিনেটর আবুরেজক এর সংশোধনীর ফলে পুলিশ এবং এর সাথে যুক্ত অন্যান্য কর্মসূচীতে মার্কিন সাহায্যের উপর গত বছর যে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেটা আরো কড়াকড়ি করা হলো…১৯৪৭ সালের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশী নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে বিদেশী গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে CIA যে তৎপরতা এতদিন চালাচ্ছিলো এই সংশোধনী তার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে চাইছে বলে মনে হয় ……বিদেশী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে CIA’র যে সম্পর্ক আছে। অনেক ক্ষেত্রে তার একটা অত্যাবশ্যকীয় অংশ হচ্ছে বিশেষ ধরণের সীমিত মাত্রার প্রশিক্ষণ এবং অন্য ধরণের কিছু সহায়তা। তাছাড়া তথ্য এবং পরামশ বিনিময় তো আছেই। এই সমস্ত কার্যকলাপ চালানোর  যদি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তবে আমাদের উপরে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা পালন করবার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে খর্ব হবে… এই সংশোধনীর ফলে জাতীয় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের স্বীকৃত লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে গৃহীত অনেক তৎপরতার কার্যকারিতা হ্রাস পাবে। যে কারনে আমরা সুপারিশ করছি সংশোধনীটি যেন পাশ না করা হয়।’’

(William Colby, Director of the CIA; William Fulbright কে এক পত্রে, ৩১ জলাই ১৯৭৪)।

“এ সম্বন্ধে আমি আরো বলতে পারি। আমার কাছে OPS কর্মতৎপরতার আরো অনেক রিপার্টে আছে। সেগুলো আমি গত বছর পেয়েছি। এর মধ্যে মার্কিন নাগরিকদের কিছু চিঠি আছে। সেই চিঠিগুলোতে এমন আভাস পাওয়া যায় যে বিদেশে নির্যাতনে মার্কিন মদদের নজির আছে। তবে বলার আর দরকার নেই, আমার মনে হয় আমি একটা কথা স্পষ্ট করতে পেরেছি। মার্কিন বিদেশী সাহায্যের যা উদ্দেশ্য তার থেকে আমাদের দেশ আজ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতায় জড়িত হয়ে পড়েছে। জননিরাপত্তা সংস্থা এবং আন্তজার্তিক পুলিশ একাডেমী অন্যান্য  CIA কর্মসূচীর প্রতি মূর্তিমান কটাক্ষ। এই সংস্থা দুটি USAID এর বিভিন্ন কার্যক্রম এবং কৃতিত্বের উপর অপরিমোচনীয় কলঙ্কচিহ্ন একে দিয়েছে… আমার বিশ্বাস, এই কার্যক্রম এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও কারাগার সাহায্য কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মতৎপরতা কংগ্রেস কতৃর্ক বন্ধ করার সময় এসেছে।” ( সিনেটর জেমস আবুরেজেক, যুক্তরাষ্ট্র সিনেট, ২০ জুন ১৯৭৪)।

বিদ্রোহ প্রতিরোধ ও জননিরাপত্তা

মার্কিন কৌশলগত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিশ্বজোড়া বিদ্রোহ দমনের কৌশল ও তত্ত্ব সব চেয়ে পরিণত হয়ে ওঠে ৬০—এর দশকে। পাশ্চাত্যে তখন সামরিক ও গোয়েন্দা মহলের সব চাইতে ধুরন্ধর অংশে যে তাত্ত্বিক বিতর্ক চলছিলো সেখানে একটা বিবেচনা খুব গুরুত্ব পাচ্ছিলো। বিবেচনাটি এ রকম ও বিভিন্ন দেশের জাতীয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটা সুক্ষ্ম অথচ গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে এবং তৃতীয় বিশ্বের চরমপহ্নী আন্দোলন নস্যাৎ করার ব্যাপারে এদের আপন আপন ভূমিকা চিহ্নিত করবার প্রয়োজন আছে। বিদ্রোহ কিংবা বিরাধেী আন্দোলন যদি তেমন গুরুতর না হয়, তবে পুলিশ অভিযান দিয়েই সেটা ঠেকানো যায়। কিন্তু সমস্যা যদি গুরুতর হয় তা হলে সেখানে জাতীয় সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে হয়। পুলিশ এ পর্যায়ে সমস্যা ঠেকিয়ে রাখতে পারলেই সব চাইতে উত্তম। কারণ সেনাবাহিনী তাদের রুক্ষ ও রূঢ় আচরণের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনতার ব্যাপক অংশের মধ্যে বিরাধে আন্দোলনের প্রতি সমবেদনা জাগিয়ে তোলে। এই যে সুক্ষ্ম বিচার,আসলে একটা বড় তত্ত্বের অংশ, সেই তত্ত্বে ইন্দোনেশীয় কায়দায় (১৯৬৫) ব্যাপক হত্যার চাইতে তৃতীয় বিশ্বের পশ্চিমাদের পোষ্য দেশগুলোতে মালয় কায়দায় (১৯৫৪) পুলিশী অভিযান অনেক বেশী উত্তম বিবেচিত হয়। যদি সেনাবাহিনীকে মাঠে না নামিয়ে, সামরিক শাসন না জারি করে, উদ্দেশ্য সাধন করা যায়, তাহলে এই সব সমাজে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ‘বাহ্যিক কেতা’ বজায় রাখা যায়। পশ্চিমা ‘মুক্ত বিশ্বের’ মৈত্রীর জন্য এ ধরণের অবস্থা একটা সামরিক জান্তার চাইতে অনেক কম বিব্রতকর।

এছাড়া কেনেডী প্রশাসনের সময় সহজ অর্থ সাশ্রয়ের ধারণাও এই অভিমতের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে কার্যকর পুলিশী তৎপরতা চাল করতে পারলে ভবিষ্যতে ভিয়েতনামের মতো ব্যাপক আকারের হস্তক্ষেপের আর দরকার হবে না। ডেভিড বার্কস নামে একজন মার্কিন সমীক্ষক মার্কিন সিনেট সাব কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ব্যাপারটা এইভাবে তুলে ধরেন।

“আমার মনে হয় আমাদের একটা বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। বাস্তব সত্যটি হচ্ছে এই রকমঃ যখন বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তখন সরকার এদের উৎখাত করার জন্য সেনাবাহিনী তলব করে। তার পর এমন একটা সময় আসে যখন সেনাবাহিনী আর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে না। কারণ সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বড্ড বেশী শক্তি ব্যবহার করে ও প্রায়ই ভুল কায়দায় সমস্যা সমাধানে তৎপর হয়। ফলে জনগণের মধ্যে একটা মেরুকরণ হয়ে যায়। তাতে এই হয় যে ধীরে ধীরে রাজনীতিসচেতন জনসমাজের বৃহত্তর অংশ বিপ্লবী কিংবা বিদ্রোহী শক্তির সমর্থক হয়ে যায় …… অথচ অন্যদিকে একটা বেসামরিক পুলিশ বাহিনী সব সময় জনতার কাছাকাছি থাকে। এরা তাঁদের প্রাত্যহিক কাজ কর্মে সাধারণ আইন ভঙ্গকারীদের ধরছেন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখছেন আর তাই যখনই কোন বিদ্রোহ সমস্যা দেখা দেয়। তখনই তাঁরা চটপট কাজে লেগে যেতে পারেন।

বার্কস—এর মন্তব্য Agency for International Development (AID) এর পরিচালকের বক্তব্যে প্রতিধ্বিনিত হয়েছে ১৯৬৪ সালে AID মঞ্জুরীর উপর সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সরকার এবং জনতার মধ্যে পুলিশ একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর যোগাযোগ ক্ষেত্র। এরা অস্থিরতার কেন্দ্রস্থলের খুব কাছাকাছি থাকেন এবং দীর্ঘমেয়াদী আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় জনতা সেনাবাহিনীর চাইতে এদের পছন্দ করেন।Ó

এ ধরনের কৌশলগত ভাবনা থেকে মার্কিনীদের বিদেশী পুলিশ বাহিনী প্রশিক্ষণের ব্যাপক প্রসার ঘটলো। কেনেডী প্রশাসন সামগ্রিক বিদ্রোহ প্রতিরোধ কর্মসূচীর এই দিকটা জননিরাপত্তা সংস্থার মাধ্যমে পুর্নগঠিত ও পনরজ্জীবিত করলো। সংস্থাটির কার্যক্রম ১৯৭৫ পর্যন্ত চলে। তারপর মার্কিন কংগ্রেস কর্মসূচী বন্ধ করে দেয়। কারণ একটি সিনেট প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র গ্রহীতা দেশগুলোতে পুলিশী সন্ত্রাসের সাথে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কর্মসূচী বন্ধ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত  OPS কার্যক্রমের অধীনে আন্তর্জাতিক পুলিশ একাডেমী এবং অন্যান্য মার্কিন সংস্থায় ৭,৫০০ সিনিয়র অফিসারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং OPS এর সাথে যুক্ত বিদেশী একাডেমীগুলোতে প্রায় ১০ লক্ষ সাধারণ পুলিশের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে AID—এর অধীনে কেনেডী প্রশাসন ‘জননিরাপত্তা’র বিশেষ ব্যুরো সংগঠিত করবার পর OPS পাকিস্তানে একটি বড় কার্যক্রম আরম্ভ করলো। পরের দশকে পরিমাণগত বিচারে কোন বিদেশী পলিশ বাহিনীকে সাহায্যের দিক থেকে পাকিস্তান মার্কিন সাহায্যের চতুর্থ বৃহত্তম ভাগ লাভ করে। এর আগের তিনটি দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। অন্যান্য জায়গার মত এখানেও কর্মসূচীর দু’টো দিক ছিলো বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির পরিচালনার দক্ষতা সম্পন্ন অধিক অফিসার প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তির অবকাঠামো উন্নয়ন। Freedom of Information Act—এর অধীনে OPS এর একটি দলিল অনুযায়ী মার্কিন প্রশিক্ষণের লক্ষ্য ছিলো নিম্নরপঃ

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশাসনিক কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে তোলা সব চাইতে ভাল হয় লোক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার একটি মিশ্র কর্মসূচী গ্রহণ করলে। আধুনিক পুলিশ প্রশাসন ও কর্ম তৎপরতায় প্রশিক্ষণ র্কমসূচীর লক্ষ্য হচ্ছে মাঝারি ও উচু পর্যায়ের পুলিশ নির্বাহী র্কমকতার্গণ, যাতে এরা প্রচলিত ঔপনিবেশিক পদ্ধতির পরিবর্তনে প্রভাব রাখতে পারেন।

এক দশকের মধ্যে প্রশিক্ষণার্থীরা এমন সব পদে উঠে আসেন যেখান থেকে শুধুমাত্র প্রচলিত পদ্ধতিই নয়, তার চাইতে অনেক বড় বড়। বিষয়ে এরা প্রভাব রাখার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। অচিরেই তাঁরা অভ্যুথান, পাল্টা অভ্যুত্থান, হত্যাকাণ্ড, ইত্যাদিতে মদদ দিতে থাকেন এবং বাংলাদেশে ১৯৭৬—৭৮ এর মধ্যে এই পুলিশ ক্যাডার রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখ্য অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক পদগলো দখল করে।

১৯৭১—এর বাংলাদেশ সংকটের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন বিকল্পগুলোর ব্যাপারে গবেষণা করার সময় কানেগীর গবেষকরা মার্কিন সরকারী সংস্থা এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা সার্ভিসের মধ্যে যোগাযোগে এবং সম্পর্ক অনুসন্ধান করে দেখেছেন। AID—এর জননিরাপত্তা কর্মসূচীর পরিচালক জ্যাক গয়েনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে কার্নেগীর গবেষকরা এ ধরণের কর্মসূচীর কৌশলগত যৌক্তিকতা সম্বন্ধে একটা সংক্ষিত সার শুনতে পানঃ

Òদেখুন, বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সরকার, বিভিন্নভাবে সংগঠিত। তাদের কাজ করবার রীতিও ভিন্ন। কিন্তু তাদের সবার একটা বিষয়ে অভিন্নতা আছে—তারা একটা বেসামরিক পুলিশ বাহিনী দিয়ে দেশে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। যখন একটা দেশ আমাদের জানায় যে এ কাজটি তারা একা করতে পারছেন না, এবং তাদের এ ব্যাপারে সাহায্য দরকার, তখন আমরা এটাকে সমগ্র উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করি। এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশে জননিরাপত্তা কর্মসূচী চালু করবে কিনা সেটা আংশিকভাবে নির্ভর করে সেই দেশটাকে যুক্তরাষ্ট্র কি চোখে দেখে তার উপর। সেই দেশটাকে যদি মুক্ত দেশসমূহের পরিবারের একজন সদস্য মনে করা হয় তাহলে আমরা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি……”

“কোন সরকারই সেনাবাহিনীকে দিয়ে পুলিশের কাজ করাতে চায় না। কিন্তু এই সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। AID—এর পলিশের এখানে কিছুই করবার নেই। উরুগয়ের কথাই ধরুন না। কেউ চায় না সৈন্যরা আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য রাস্তায় নামুক, কারণ সৈন্যরা আইন শৃংখলা বজায় রাখবার একটা উপায়ই জানে—বলপ্রয়োগ। তাদের এই কায়দাটিই শেখানো হয়। তাই সেনাবাহিনীর শরণাপন্ন হলে সরকারকে বড় রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়।”

১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে পরবর্তী দশকের জন্য একটা পুলিশী কর্মসূচী প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সেখানে কয়েকটা গবেষণা মিশন পাঠায়। পূর্ব পাকিস্তানে যখন OPS এর মাঠ পর্যায়ে গবেষণা চলছিলো তখন। ১৯৬৩’র মার্চে মার্কিন মুলুকে প্রশিক্ষণ নেবার জন্য প্রথম বাঙালী প্রশিক্ষণার্থীদের আগমন ঘটে। তাঁরা আন্তজার্তিক পুলিশ একাডেমী (IPA), আন্তজার্তিক পুলিশ সার্ভিস স্কুল (INPOLSE), FBI— এর জাতীয় একাডেমী, এবং আরো বিশেষজ্ঞ—প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কোর্সে যোগদানের জন্য আসেন। ৬০—দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে OPS এর স্থায়ী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। কাজ ছিলো দেশের ভেতর কর্মসূচীর তত্ত্বাবধান করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের জন্য বাঙালী পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাছাই করা। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১—এর মধ্যে রবার্ট জেনাস, লিওন জে ক্লেমেন্টসও ওরভাল এল ওয়ুনার ঢাকাস্থ OPS —এ কাজ করেছেন। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে ভিয়েতনাম হতে একজন উচু পর্যায়ের OPS কর্মকর্তার চালস এফ স্লোন পূর্ব পাকিস্তানের কর্মসূচী পরিকল্পনার জন্য সেখানে উপস্থিত হন। মার্কিন সূত্রের মতে এই চারজন লোকের তিনজনেরই CIA’; সাথে সম্পর্ক ছিলো বলে অভিযোগ আছে। ঢাকায় আসবার আগে স্লোন ভিয়েতনামের জননিরাপত্তা বিষয়ক বিভাগের সহকারী সমন্বকারী ছিলেন এবং OPS এর ভিয়েতনাম বিভাগের সহকারী সংগঠক ছিলেন। ১৯৬৯—এর জানুয়ারী মাসে ঢাকায় তার সফর শেষ হয়ে গেলে পরের মাসেই তিনি ভিয়েতনাম চলে যান। সেখানে তিনি উইলিয়াম CORDS (Civil Operations and Revolutionary Development Support) শীর্ষক একটি CIA কার্যক্রমে যোগদান করেন। ভিয়েতনামী বিদ্রোহ দমনে কোলবির বিশেষ কার্যক্রম, সেই কুখ্যাত চযড়বহরী হত্যা কর্মসূচী গোটা CORDS কর্মসূচীর অধীনে ছিলো। কোলবি পরে CIA ‘র পরিচালক হন। ১৯৭১—এ পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের পর যখন মার্কিনীদের দেশত্যাগ ছাড়া উপায় থাকলো না, তখন ওয়ুনার এবং জেনাস দুজনেই ভিয়েতনামে ফিরে গিয়ে CORDS এ যোগদান করেন। স্লোনের মতো তাঁরাও ভিয়েতনামে আগে কাজ করেছিলেন। ক্লেমেন্টসকেও ঢাকা থেকে ফেরার পর ভিয়েতনামে পোস্টিং দেওয়া হয়, কিন্তু সেটা CORDS —এর অধীনে নয়।

পাকিস্তান এবং এর পূর্ব প্রদেশ হতে যুক্তরাষ্টে; একধারসে গোয়েন্দানবীশ কর্মকর্তা, ঝঢ়বপরধষ ইৎধহপয এর কর্মকর্তা এবং পুলিশ যোগাযোগ কর্মকর্তারা IPA এবং INPOLSE তে আসতে লাগলেন। ১৯৬১ হতে ১৯৭১সে বছর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলো ——১১৩ জন উচঁু এবং মাঝারি পর্যায়ের পাকিস্তানী পুলিশ কর্মকর্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

Freedom of Information এর অধীনে যে খবর আমরা পেয়েছি তাতে দেখা যায় যে এই প্রশিক্ষণার্থী দলে অন্তত ৪০ জন ছিলেন পুলিশ ও গোয়েন্দা ক্যাডারের বাঙালী। পরবর্তীকালের বাংলাদেশের মতো পূর্ব পাকিস্তানেও পূলিশ ও গোয়েন্দা আমলাতন্ত্রে কোন ভেদাভেদ দেন দেখা হতো না। আঁগের মতো এখনও এ সার্ভিস দুটো পরস্পরের সম্পূরক ঐ একই সময়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ৪১৪ জন পুলিশ র্কমকর্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন—এই হিসেবটা মনে রাখলে এবং সে সময় ভিয়েতনামে ব্যাপক মার্কিন উপস্থিতির কথা বিবেচনায় রাখলে স্বীকার করতেই হয় যে মার্কিন ইনস্টিটিউট গুলোতে পাঠানো পাকিস্তানী প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা মোটেও নগণ্য ছিলো না। যাঁরা তখন প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন তাঁর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন এবং তখন না হলেও ভবিষ্যতে তাঁদের সব সার্ভিসের কর্তৃত্ব গ্রহণ করছিলেন। এ বি এস সফদার, আবদুর রহিম, এস এ হাকিম, মুসা মিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আমির খসরু, এম এন হদা, এ কে, মোসলেউদ্দিন, আবু সৈয়দ শাহজাহান, এ এম এম আমিনুর রহমান, গোলাম মোর্শেদ, আলী এম জামশেদ, আবদুল খালেক খান, এ এইচ নুরুল ইসলাম, জাফরল হক, খন্দকার গোলাম মহিউদ্দিন—অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রশাসনের সকল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের IPA এবং INPOLSE ইনষ্টিটিউটগুলোতে ক্লাস করবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশে তাঁরা রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটা গোপন রাষ্ট্র তৈরী করে ফেললেন। এটি আড়ালবতীর্ হলে কি হবে, দেশের রক্তাক্ত সহিংস ইতিহাসে অনেক ঘটনায় এটি বিরাট নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৭১—এর আগের বছরগুলোতে পুলিশ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের উপর নজর রাখা, তাঁদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা, তাঁদের অন্তরীণ রাখা এবং তাঁদের বিচার করবার কাজে জড়িত ছিলেন। শুধুমাত্র একজন উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকতা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বেচেঁছিলেন। এছাড়া পুলিশ সার্ভিস, Intelligence Bureau(IB) এবং Special Branch(SB)—এর প্রায় সকল উঁচু পর্যায়ের বাঙালী কর্মকর্তারা ২৫ মার্চের পর প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালালী করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে। এরাই বাংলার নব্য মীরজাফর। আমরা আগেই যেমন বলেছি, তরণ জাতীয়তাবাদীদের দাবী সত্ত্বেও স্বাধীনতার পরে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু এদের সরকারী দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

CIA এর পুলিশ প্রশিক্ষণ বনাম আবুরেজক সংশোধনী

পরবতীর্ বাংলাদেশে NSI নামে যে গোয়েন্দা সংস্থা গঠিত হয় তার মহারথীদের যেসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ১৯৭৫—এ মার্কিন কংগ্রেস আইন করে সে সব নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৭৫—এ জুলাই থেকে বিদেশী পুলিশ কারাগার কিংবা আইন রক্ষাকারী যে কোন প্রতিষ্ঠানে USAID —এর তহবিল থেকে কোন আর্থিক সাহায্য দেওয়া নিষিদ্ধ।’ OPS নিষিব্ধ করবার অভিযান শুরু করেন সাউথ ড্যাকোটা। অঙ্গরাজ্যের সিনেটর জেমস আবুরেজক Foreign Assistance Act—এর এই বির্তকিত সংশোধনী সম্বন্ধে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ১৯৭৪—এর জুন মাসে মার্কিন সিনেটে আবুরেজক বলেনঃ

“যে সমস্ত দেশে মার্কিন ব্যবসা বাণিজ্য এবং পুজি বিনিয়োগ সুপ্রতিষ্ঠিত সেখানে সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা ১৯৫০—এর শেষ দিক হতে মার্কিন কৌশলতাত্তিকদের কাছে বিরাট গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। মার্কিন সামরিক পরিকল্পনাও একথাটা স্মরণে রেখে করা হয়েছে যাতে গণবিদ্রোহের হুমকির মুখে বন্ধুপ্রতিম শাসকদের মুহুের্তর মধ্যে বিদ্রোহ দমনের জন্য বিমানপথে সামরিক সাহায্য পাঠানো যায়। গ্রামীণ গেরিলা বাহিনী দমনে সেখানকার নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীকে অধিকতর পারঙ্গম করে তোলার কাজে মার্কিন সামরিক কার্যক্রম কাজে লাগানো হয়েছে। নাশকতা তৎপরতার বিরদ্ধে প্রতিরক্ষার প্রথম পর্যায় পুলিশ—এই বিবেচনার উপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা মারফত তৃতীয় বিশ্বের পুলিশ বাহিনীর হাতে মার্কিন অর্থ এবং অন্যবিধ সাহায্য তুলে দেওয়া হয়েছে… সামরিক সাহায্য কার্যক্রমের তুলনায় জননিরাপত্তা কার্যক্রম অতো বড় নয়—কিন্তু এর সমর্থকরা এই কার্যক্রমের সমর্থনে কিছু উল্লেখযাগ্যে যুক্তি উপস্থাপন করেন। যেমন ধরুন যুক্তি দেখানো হয়েছে যে পুলিশ জনতার মাঝে মিশে থাকে। তাই স্বপমাত্রার বিদ্রোহ দমনে তাঁরা সেনা বাহিনীর চাইতে কার্যকর। পুলিশ সাহায্য কার্যক্রমের সমথর্করা একথাও বলে থাকেন যে সামরিক বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের চাইতে পুলিশ বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ আরো কম ব্যয়সাপেক্ষ কারণ এ ক্ষেত্রে প্লেন, ট্যাংক, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের মতো এতো ব্যয়বহল সরঞ্জাম প্রয়োজন হয় না।”

“CIA—এর প্রাক্তন কর্মকর্তা কর্নেল এডওয়ার্ড ল্যান্সডেলের মতো ব্যক্তিরা যে সব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তা ১৯৬০ —এর গোড়ার দিকে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী ও তার ভাই তদানীন্তন অ্যাার্টনী জেনারেল রবার্ট কেনেডীর কাছে সবচাইতে বেশী ইতিবাচক সাড়া লাভ করে … পররাষ্ট্র দফতরের যে স্মারকপত্রের মাধ্যমে OPS স্থাপিত হয় সেটির জোরালো ভাষা লক্ষণীয়—১৯৬২ এর নভেম্বরে প্রকাশিত স্মারকপত্রটিতে ঘোষণা করা হয় যে AID/OPS এর উপর … অন্যান্য AID—এর যে কোন কারিগর দফতর বা বিভাগের চাইতে বেশী ক্ষমতা অর্পণ করছে। তৃতীয় বিশ্বের পুলিশতে OPS তিনভাবে সহায়তা করবার এখতিয়ার লাভ করেঃ প্রথমত, Ôজননিরাপত্তা উপদেষ্টাÕ পাঠিয়ে গ্রহীতা দেশে সাধারণ পুলিশ প্রশিক্ষণ দেওয়া—এ ক্ষেত্রে গ্রহীতা দেশের ব্যয়ভার বহন করার কথা; দ্বিতীয়ত IPA ও অন্যান্য মার্কিন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকতাদের প্রশিক্ষণ দান ; তৃতীয়ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারদ, বেতার সরঞ্জাম, গাড়ী,জীপ, তেল, রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম সরবরাহ… জনাব সভাপতি, OPS —এর আরো কিছু কার্যক্রম আছে যা আমাকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে। গত বছর প্রাপ্ত রিপোর্টে আমি জানতে পেরেছি যে টেক্সাসের এক প্রত্যন্ত মরু শিবিরে মার্কিন সরকার বিদেশী পুলিশকে বোমার প্রস্তুতির, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। টেক্সাসের লস ফ্রেস্নসে অবস্থিত সীমান্ত প্রহরা একাডেমীতে IPA প্রশিক্ষকগণ বিদেশী পুলিশকে ঘরে তৈরী বোমা প্রস্তুতি, ডিজাইন ও সম্ভাব্য ব্যবহার সম্বন্ধে শেখাচ্ছেন। ১৯৬৯—এ কোর্সটি সূচনার পর অন্তত ১৬৫ জন পুলিশ এই Ôকারিগরী অনুসন্ধান কোর্সÕ—এ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।Ó

‘বোমা প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ স্কুল ছাড়াও আমি জানতে পেরেছি যে নর্থ ক্যারোলাইনার ফোর্ট ব্র্যাগ—এ মনোবিজ্ঞান কর্মতৎপরতা স্কুলে IPA স্নাতকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। স্কুলটি ফোট’ ব্র্যাগস্থ যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সামরিক সহায়তা ইনস্টিটিউটের  অধীন। এই কার্যক্রমে যেসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় তার কয়েকটির শিরোনাম এরকম বিদ্রোহী নাশকতা পদ্ধতি; অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ও তার রক্ষণে মনস্তাত্ত্বিক কর্মতৎপরতার ব্যবহার ; আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষায় গোয়েন্দাবৃত্তির ভূমিকা। এ্যাডকিন্সের মতে স্কুলের উদ্দেশ্য সেনাবাহিনী কি করে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের নানা সমস্যা মোকাবেলা করে সে ব্যাপারে পুলিশকে প্রশিক্ষণ দান।”

এ সম্বন্ধে আমি আরো বলতে পারি আমার কাছে OPS কর্ম’তৎপরতার আরো অনেক রিপার্টে আছে। সেগুলো আমি গত বছর পেয়েছি। এর মধ্যে মার্কিন নাগরিকদের কিছু চিঠি আছে। সেই চিঠিগুলোতে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে যে বিদেশে নির্যাতনে মার্কিন মদদের নজির আছে। তবে বলার আর দরকার নেই, আমার মনে হয় আমি একটা কথা স্পষ্ট করতে পেরেছি। মার্কিন বিদেশী সাহায্যের যা উদ্দেশ্য, আমাদের দেশ আজ তার থেকে সমপূর্ণ বিচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতায় জড়িত হয়ে পড়েছে।

জননিরাপত্তা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক পুলিশ একাডেমী অন্যান্য কর্মসূচির প্রতি মূর্তিমান কটাক্ষ। এই সংস্থা দুটি AID এর বিভিন্ন কার্যক্রম এবং কৃতিত্বের উপর অপরিমোচনীয় কলঙ্কচিহ্ন একে দিয়েছে… আর বিশ্বাস যে এই কার্যক্রম এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মতৎপরতা কংগ্রেস কর্তৃক বন্ধ করার সময় এসেছে।” ( সিনেটর জেমস আবুরেজক সিনেট, ২০ জুন ১৯৭৪)

মার্কিন কংগ্রেসে আবুরেজক সংশোধনী গৃহীত হবার আগে এই নতুন আইনটি পাশ করবার বিরদ্ধে একটি পাল্টা অভিযান আরম্ভ হয়। এই অভিযানের নেতৃত্বে দেন CIA’র পরিচালক উইলিয়াম কোলবি। ১৯৭৪—এর জুলাইয়ের শেষদিকে উইলিয়াম ফুলব্রাইটকে এক ব্যক্তিগত পত্রে কোলবি আবুরেজক সংশোধনীর বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান। তিনি বলেন, ষে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের কাছ থেকে বিদেশী গোয়েন্দাতথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে পুলিশ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম খুবই কাজে এসেছে। কোলবির চিঠি সংবাদপত্রের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। ফুলব্রাইটকে কোলবি লেখেনঃ

“১৯৭৩—এর Foreign Assistance Act— এর অংশ হিসেবে পুলিশ এবং এর সাথে যুক্ত অন্যান্য কর্মসূচীতে মার্কিন সাহায্যের উপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সিনেটের আবুরেজকের সংশোধনীর ফলে তার আরো অনেক কড়াকড়ি করা হলো। ১৯৭৩ সালের বিধিনিষেধ শধুমাত্র Foreign Assistance Act— এর আওতাধীন কার্যক্রমের উপর প্রযোজ্য ছিলো, কিন্তু আবুরেজক, সংশোধনী যে কোন আইনের আওতাধীন কিছু বিশেষ ধরণের তৎপরতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে। আবুরেজক সংশোধনীর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আইনে যেখানে শুধু, বিদেশী পুলিশ সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, এই সংশোধনী কোন বিদেশী সরকারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা বা আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দাবৃত্তির কোন কার্যক্রমে অংশ গ্রহণেও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।……”

“১৯৪৭ সালের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশী। নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে CIA বিদেশী গোয়েন্দাতথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এত দিন যে কর্ম তৎপরতা চালাচ্ছিলো, এই সংশোধনী তার উপর কড়াকড়ি আরোপ করতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। উপরন্ত, বিশ্বের বহু জায়গায় মার্কিন নাগরিক, প্রতিষ্ঠান বা নিরাপত্তা স্বার্থ বিদেশী আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থাসমূহের কর্মক্ষমতা এবং সহযোগিতার উপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল সন্ত্রাস ও মাদকদ্রব্য ব্যবসা প্রতিরোধ তৎপরতার  ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। বিদেশী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সার্ভিসগুলোর সাথে CIA—র যে সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে তার একটা অত্যাবশ্যকীয় অংশ হচ্ছে বিশেষ ধরণের সীমিত মাত্রার প্রশিক্ষণ এবং অন্য ধরণের কিছু সহায়তাদান। তাছাড়া তথ্য ও পরামর্শ বিনিময় এ আছেই। এই সমস্ত কার্যকলাপ চালানোর উপরে যদি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তবে আমাদের উপরে তথ্য সংগ্রহের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা পালন করবার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে … জাতীয় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের স্বীকৃত লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে গৃহীত অনেক তৎপরতা এই সংশোধনী খর্ব করবে। সে কারণে আমরা সুপারিশ করছি সংশোধনীটি যেন পাশ না করা হয়।’’ ১৯৭৪—এর গ্রীষ্মের অন্যান্য কংগ্রেস শুনানীতে OPS কার্যক্রমের মাধ্যমে CIA—এর বিদেশী পুলিশ অনুপ্রবেশের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধিসভার পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির মার্কিন অর্থে IPA প্রশিক্ষণ সম্পর্কিদ শুনানীতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (AID) পরিচালক ড্যানিয়েল পাকার্র পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সভাপতি ডোনাল্ড ফ্রেসারের কাছে স্বীকার করেন যে CIA —এর কাজে AID এবং OPS উভয়ই ব্যবস্থত হয়েছে।

মিঃ ফ্রেসারঃ আচ্ছা, CIA’র বিদেশী কর্মতৎপরতায় OPS মিশনগুলো কি কখনো ব্যবহৃত হয়েছে ? CIA —এর লোক কি কখনো বাইরের OPS মিশনে কাজ করেছেন ?

মিঃ পার্কারঃ  AID/OPS এর সাথে CIA মিশনগুলোর একটা সহযোগিতামূলক বন্দোবস্ত আছে। এ সন্ধে বিশদ জানতে চাইলে সেই সংস্থাটিকেই (CIA) জিজ্ঞেস করতে হবে …

মিঃ ফ্রেসারঃ জিজ্ঞাসাবাদের কোন কায়দা কানুন সম্পর্কে জ্ঞান দান কি IPA (আন্তর্জাতিক পুলিশ একাডেমী) প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত ? আপনার কি মনে হয় যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের পুলিশকে গণতান্ত্রিক বিরোধীপক্ষ দমন করার কাজে সহায়তা করতে পারে ?

মিঃ পার্কারঃ IPA অতে অপরাধ অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ কোর্সের অংশ হিসেবে জেরা ও জিজ্ঞাসাব বিষয়ে শেখানো হয়। আমাদের মত হচ্ছে এই কোর্স কার্যকর করবে সামরিক পুলিশ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় একটি ধাপ, আবার উন্নয়নের প্রয়েজনীয় পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটি কার্যকর পুলিশ প্রতিষ্ঠান আবশ্যক। পদ্ধতিটি রাজনীতিনিরপেক্ষ, তবে পরবর্তীতে  এখানে প্রশিক্ষিত পুলিশ এই পদ্ধতি দমন—নির্যাতনে ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু পাঠ্যক্রম এ ধরণের দমনের ব্যাপারে কোন সরাসরি প্ররোচনা দেয় বলে আমি স্বীকার করি না।

মিঃ ফ্রেসারঃ আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি তা হলো OPS কার্যক্রমের পেছনে একটা অন্যতম বিশ্বাস হচ্ছে এই যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সহিংস উৎখাত কখনো কাম্য নয়। ঠিক কিনা? সে ক্ষেত্রে আলেন্দে সরকারের উৎখাতে AID আর OPS কি অখুশি ?

মিঃ পার্কারঃ আপনি ঠিক বলেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও AID এর জননিরাপত্তা কার্যক্রমের পেছনে একটা অন্যতম বড় বিশ্বাস হচ্ছে গণতান্ত্রিকভাবে নিবার্চিত কোন সরকারের সহিংস উৎখাত অবাঞ্ছিত মনে করা। আলেন্দে সরকারের উৎখাতে আমি খুশি নই।

১৯৭৫—এ সারা বছর ধরে পুলিশ, প্রশিক্ষণ জননিরাপত্তা কার্যক্রম ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যোগসাজশের সংবাদ ফাঁস হতে থাকে। সেই সাথে চর দলভুক্ত করবার নতুন নতুন ইনষ্টিটিউট ও চিহ্নিত হতে থাকে। ১৯৭৫—এ  The CIA and th: Cult of Intelligence —এর লেখক জন মার্কস ও টেইলার ব্রাঞ্চ INPOLSE  নামে একটা অদ্যাবধি অজানা পুলিশ প্রশিক্ষণ স্কুলের সংবাদ উদ্ধার করেন। Freedom of Information Act —এর আওতায় পরবতীর্তে প্রাত নথিপত্র ও তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে বাংলাদেশের বর্তমান NSI —এর বেশ কিছু হোমরা চোমরা কর্মকর্তা INPOLSE  তে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। Harper’s Weekly—তে প্রকাশিত মার্কস ও টেইলারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঃ

‘‘কিছু স্বতন্ত্র সূত্রে আমরা পাকা প্রমাণ পেয়েছি যে প্রায় ২৩ বছর ধরে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের আড়ালে  International Police Services Inc. (INPOLSE) CIA এর অঙ্গ সংস্থা হিসেবে কাজ করে এসেছে। বিদেশী পুলিশ বাহিনীকে পুলিশী সরঞ্জাম অথার্ৎ অত্র, গোলাবারুদ, হাতকড়া, হোলস্টার, উর্দি, রেডিও এবং অনুন্নত প্রযুক্তির আড়ি পাতার সরঞ্জাম ইত্যাদি রপ্তানি করা সংস্থাটির সমগ্র কার্যক্রমের একটা অংশ। কিন্তু কিছু INPOLSE  কর্মকর্তার মতে বৃহত্তর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে এই রপ্তানী। একটি অনুষঙ্গ মাত্র। গত বছরগুলোতে সারা বিশ্বে ৮৭ টি দেশের হাজার হাজার বিদেশী পুলিশকে INPOLSE  পুলিশী কর্মতৎপরতার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছে।”

“লাতিন আমেরিকায় নয় বছর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাবেক CIA  চর ফিলিপ এজি ১৯৬৫ সালের উরুগুয়েতে একজন চর আলেহান্দ্রো ওতেরোকে কিভাবে INPOLSE  —তে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন। ওতেরো তখন উরুগুয়ে তে মোন্তেভিদিও পুলিশ বিভাগের — প্রধান লণ্ডনে এক সাক্ষাৎকারে এজি বলেছেন যে গুতেরোকে তৎকালীন সব চেয়ে শক্তিশালী উরুগুয়ে বিপ্লবী গোষ্ঠী ‘তুপামারো’দের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ওয়াশিংটনে বিশেষ কোর্সে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।”

তিনি আরো বলেন যে জর্জ টাউনের একটা গুদাম ঘরে অবস্থিত AID এর নিজস্ব আন্তজার্তিক পুলিশ একাডেমী (IPA), যেটা INPOLSE ‘র মতোই, সেটি CIA ই আসলে স্থাপন করেছে। তিনি বলেন যে, নিজেদের কর্মতৎপরতার আড়াল হিসেবে CIA  চরেরা হামেশাই AID—এর জননিরাপত্তা কার্যক্রম ব্যবহার করে। এছাড়া CIA  নিজ সংস্থার জন্য স্থানীয় পুলিশ হতে চর নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিদেশী পুলিশের সাথে AID. এর যোগাযোগ কাজে লাগায়। এজি স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বললেন যে তিনি ওতেরোর প্রশিক্ষণের জন্য যে অনুরোধ করেছিলেন, সেটা CIA  সদর দফতরে জেমস এ্যাঙ্গলটনের কাউন্টার—ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কাছে পাঠানো হয় এবং পরে ওতেরোকে ১২ সপ্তাহের জন্য IPA ও চার সপ্তাহের জন্য CIA ‘র নিজস্ব স্কুল’ INPOLSE  তে পাঠানো হয়।”

“গত মাসে CIA ‘র নীতিমালা (আপাত দুটিতে ?) লংঘন করে ব্যাপক আভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় যিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন—ইনিই CIA  কর্মকর্তা এ্যাঙ্গলটন এজি বলেছেন এবং আরো তিনটি সূত্র তাঁর বক্তব্য সমর্থন করেছে—যে এঙ্গলটনের কাউন্টার—ইন্টেলিজেন্স দফতর CIA —এর বিশ্বজোড়া পুলিশ প্রশিক্ষণ যোগাযোগ ও অনেক অনুপ্রবেশ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা জানতে পেরেছি যে ওতেরোর মত ব্যক্তিদের যে কার্যক্রমের অধীনে প্রশিক্ষণের জন্য আনা হয়ে থাকে তার সংক্ষিপ্ত নাম DT BAIL। ১৯৬২ সালে এ্যাঙ্গলটনের এক কর্মচারী বায়রন এঙ্গেল CIA  থেকে বদলী হয়ে AID —এর গোটা OPS  কার্যক্রমের প্রধান হয়ে যান—কংগ্রেসের যত শুনানী বা অনুসন্ধান হয়েছে, তার কোনটাই INPOLSE  কার্যক্রমের কোন সংবাদ প্রকাশ করেনি। অথচ এটি IPA’র চাইতেও পুরনে এবং আয়তনে অন্তত IPA’র সমান।”

“স্কুলটি পুলিশ একাডেমীর একটি সমান্তরাল সংস্থা হিসেবে কাজ করে। বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষক এটিকে IPA’র একটি স্নাতকোত্তর স্কুল হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ফিলিপ এজি বলেছেন যেসব CIA  প্রশিক্ষকদের পুলিশ একাডেমীতে রাখলে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে,তাদের আড়াল করার জন্য INPOLSE  ব্যবহার করা হয়। CIA  এর সদর দফতর হতে দুবছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন এমন একজন উচ্চ পর্যায়ের CIA  কর্মকর্তা বলছেন যে INPOLSE  এমন দায়িত্ব পান, যা IPA’র পক্ষে করা সম্ভব নয়। Freedom of Information Act —এর আওতায় প্রাপ্ত তথ্য এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালী কর্মকতার্দের জয় এক তৃতীয়াংশ IPA ও অন্যান্য ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ শেষ করে INPOLSE  তে প্রশিক্ষণের জন্য এসেছেন। বর্তমানে এদের প্রায় প্রত্যেকেই NSI অথবা আধাসামরিক পুলিশের উচ্চতম পদে আসীন।

পুলিশ টেলিযোগাযোগ ও সামরিক সাহায্য

যুক্তরাষ্ট্রে সিনিয়র পুলিশ গোয়েন্দা কর্মকতার প্রশিক্ষণ ছাড়াও ১৯৬৩ সালে OPS  পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামোর সাবির্ক বিস্তারের সাথে কি ধরণের কারিগরী অবকাঠামো সঙ্গতিপূর্ণ ও দরকারী হতে পারে সেটা যাচাই করবার উদ্দেশ্যে কয়েকটা মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান কর্মে হাত দেয়। প্রথম পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক যোগাযোগ গ্রিডের বিকাশের উপর খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৩৬ সালে এর কারিগরী বিভাগের একজন সিনিয়র টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী পল কার্টুজ পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। পাকিস্তানের IB’র (Intelligence Bureau) যুগ্ন পরিচালক ও জননিরাপত্তা কার্যক্রমের সূচনাপূর্বের প্রধান লিয়াজো অফিসার ব্রিগেডিয়ার আজহার তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। কাটুজের এখানে আসবার মূল উদ্দেশ্য ছিলো পাকিস্তানের IB, পশ্চিম পাকিস্তানের রেঞ্জার, সীমান্ত পুলিশ, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পুলিশের বিস্তারিত যোগাযোগ চাহিদার জরীপ করা। Freedom of Information Act —এর আওতায় প্রাপ্ত কাটুজের মিশন প্রতিবেদন অনুযায়ী পুলিশ যোগাযোগে গুরুতর ঘাটতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে ব্রিগেডিয়ার আজহার পরামর্শ দেন… যোগাযোগ সম্পর্কিত জরীপে প্রকাশ পেয়েছে যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক অভ্যস্তরীন নিরাপত্তা বাহিনীর যোগাযোগ প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক হলেও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পুলিশের (EPP) প্রয়োজন অনেক বেশী অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযুক্ত কারণ এই এলাকায় কোন পুলিশ যোগযোগ ব্যবস্থাই নেই। কাটুজের ৪২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আরো কিছু বিস্ত„ত সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ রয়েছেঃ

“পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পুলিশের (EPP) সমস্যার মাত্রা বোঝা সহজ হবে তবে যদি আমরা মনে রাখি যে ৫ কোটিরও বেশী মানুষ আধ্যুযিত —৫৫,০০০—এরও বেশী বর্গমাইল এলাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রন আইন শৃঙ্কলা রক্ষা ও অন্তঘার্তমূলক তৎপরতা দমন ও বেসামরিক অস্থিরতা এর জন্য ২৫,০০০ সদস্য সম্বলিত পুলিশ বাহিনীর হাতে বলতে গেলে কোন যোগাযোগ ব্যবস্থাই নেই …”

“অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা তৎপরতায়, আড়ি পাতার হাত হতে যোগাযোগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরী। সেকারণে সাংকেতিক যোগাযোগের একটা উপায় প্রয়োজন। বর্তমানে সেটি লভ্য নয়— এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রন খর্ব অথবা নষ্ট করবার জন্য এখতিয়ার বর্হিভূত আদেশ পাঠানো হয়েছে। EPP— এর যদি ব্যবস্থাটির পরিচালনা ও মালিকানার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে তবে এ ধরণের শংকা হতে মুক্ত হওয়া সম্ভব…’’

“উপরন্তু বেসামরিক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায়ই কাজে বিঘ¥ ঘটার বদনাম আছে। পাকিস্তানের ডাক ও তার বিভাগের সাম্প্রতিক ধর্মঘটের হুমকি সৌভাগ্যক্রমে সেটা ঠেকানো গেছে——একটি স্বনির্ভর পুলিশী নিরাপত্তা টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কে’র আবশ্যকতা পরিষ্কার করে তোলে ——বিশেষ করে সামাজিক গোলযোগের সময়ই টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাটি স্বনির্ভর হওয়া চাই।”

পূর্ব পাকিস্তানে আসার চার মাস আগে কাটুজ লাতিন আমেরিকায় একটি অভিন্ন সফরে যান। সেখানে তিনি কলোম্বিয়ার জাতীয় পুলিশ এবং সেদেশের রাজনৈতিক পুলিশ সংস্থা নিরাপত্তা প্রশাসন বিভাগ   (DAS)—এর যোগাযোগ ব্যবস্থার খোঁজ নেন। বোগোতায় কাটুজের সুপারিশ ঢাকার সুপারিশের চেয়ে খুব ভিন্ন ছিলো না। বিশ্বব্যাপী লক্ষ্যটা তো একই। কাটুজ যুক্তি দেখান যে DAS ও বেসামরিক পুলিশ উভয়ে আলাদা আলাদা অপ্রতুল যোগাযাগে ব্যবস্থা চালু রাখছে বলে উভয়ের কাজ অসুবিধে হচ্ছে। কাটুজ, বললেন যে দু’টো একত্র করে যৌথভাবে চালানো হোক। তিনি সুপারিশ জানান যাতে তাঁর প্রস্তাব গ্রহণে কলোম্বিয়া সরকারের সম্মতি AID—এর সাধারণ সাহায্যদানের পূর্বশর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত কলোম্বিয়া সরকার কাটুজের পরিকল্পনা গ্রহণে রাজী হয়। কোটি কোটি ডলার খরচ করে একটি দেশব্যাপী আধুনিক রেডিও টেলিটাইপ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহকৃত এ ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে এ সব দেশের গুরতর সংকট মুহুর্ত পাশ্চাত্যের জন্য তথ্য ও সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে থাকলে, সেটা বলা বাহুল্য। মার্কিন ও বিলেতী সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে পাশ্চাত্যের বিশ্বব্যাপী সাংকেতিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের (SIGINT—Signal Intelligence) বিকাশে ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের অর্থবহ প্রভাব আছে। ব্রিটিশ সাপ্তাহিক New Statesman এর মতেঃ “(বিলেতের) GCHQ (Government Communicatioins Headquarters) বহুজাতিক ÔSIGINTÕ চক্তির শরীক। SIGINT এর কাজ হলো বিশ্বব্যাপী ঘটনাবলীর উপর নজর রাখা। এই মৈত্রীর মূলসূত্র, ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা। এর নাম UKUSA চুক্তির পরে ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যাড এই মৈত্রীতে সামিল হয়ে যায়। প্রতিটি শরীক সংস্থা— NSA ,GCHQ, অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা সংকেত বিভাগ (DSD) ও কানাডার জাতীয় গবেষণা পরিষদের যোগাযোগ শাখা (CEBRC) —এক একটি বিশেষ এলাকায় SIGINT তৎপরতার দায়িত্বে নিয়োজিত। GCHQ—এর ভাগে পড়েছে অফ্রিকা এবং উরাল পর্বতের পশ্চিমে অবস্থিত ইউরোপের অংশ…গত তিরিশ বছরে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রভূত বৃদ্ধির সাথে সাথে SIGINT সংস্থাগুলোরও সমানতালে আয়তনস্ফীতি ঘটেছে। NSA—এর (যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা) বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ১,২০,০০০ কর্মচারী আছে। ১৯৭৫ সালে মার্কিন সিনেটের Church Committee NSA কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন নাগরিকের টেলিফোনও টেলেক্সবাতার্য় আঁড়িপাতার কার্যক্রমের সংবাদ উদ্ধার করে। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা NSA— কে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা সরবরাহ করে। ১৯৭৪ এর মধ্যে ৭৫,০০০ হাজার লোকের উপর বিস্তারিত নথি তৈরী হয়ে যায়।…

SIGINT এখন দুর্বলতর লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ সরিয়ে এনেছেঃ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন সরকার, ভিন্নমতাবলম্বী বেসামরিক নাগরিক, অর্থনৈতিক গোয়েন্দাতথ্য এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর নীচমাত্রার যোগাযোগ তথ্য… মিত্রদের উপরও নজর রাখা চাই কারণ একদিন এরা শত্রু হয়ে যেতে পারে; আজ যেসব দেশকে মনে হচ্ছে প্রত্যন্তে অবস্থিত সেগুলোর গতিবিধির উপর নজর রাখতে হবে, কারণ একদিন এসব দেশ বৃহত্তর সংঘাতে অঙ্গীভূত হয়ে যেতে পারে।”

পূর্ব পাকিস্তানে পল কাট্জ্ সুপারিশ করলেন যেঃ

“কিছু পযার্য়ে প্রাদেশিক সদর দফতর ঢাকার সাথে বিভাগীয় সদর দফতরসমূহ অর্থাৎ চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী এবং ১৮টি জেলার যথাযথ প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম এরূপ একটি সম্পূর্ণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা দরকার।’’ ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর উপর কার্নেগীর কাছে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে পাকিস্তানে প্রধান OPS  উপদেষ্টা জোসেফ জে কোর জানান যে —পুলিশ সহায়তা কার্যক্রম এইভাবে রূপায়িত হয়ঃ 

“ ক’বছর ধরেই আমরা পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশের সাথে যৌথভাবে একটা ব্যাপক কার্যক্রমে হাত দিয়েছিলাম। কাজটির তিনটি পর্যায়। সামগ্রিক সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিলো তিরিশ লাখ ডলার। আপনাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে সে দেশে শুধু, সামরিক ও পুলিশী যোগাযোগ ব্যবস্থাই নয়, সাধারণ টেলিফোনসহ সার্বিক যোগাযোগ সুবিধেই সীমিত ও সেকেলে ছিলো। আমাদের রূপরেখা এমন ছিলো যে প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে—এটি আসলে প্রথম পর্যায়ের অংশ ঢাকার সাথে যোগাযোগ উন্নত করার কথা। এরপর আমাদের বড় শহর হতে শহরাত্তের এলাকায় যোগাযোগ স্থাপনের কথা, এবং সর্বশেষে একে বারে নিম্নতম স্তরের কাজ।”

১৯৭১ এর মার্চে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবার আগে OPS  এই উন্নয়ন স্কীমের প্রথম দুটো পর্যায় সম্পূর্ন করে। স্বাধীনতার পর মুজিব শাসিত নতুন সরকার এই কার্যক্রমের নবায়নে বিশেষ আগ্রহী ছিলো না। নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির দু’টো সহজ কারণ ছিলো—মুক্তিযুদ্ধে কিসিঞ্জারের পাকিস্তানপক্ষপাত এবং OPS  এর অধিকাংশ বাঙালী প্রশিক্ষণার্থীর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালালী। দু’টো কারণেই ঠিক এ ধরণের মার্কিন বদান্যতার প্রতি নতুন সরকার অনীহ ছিলো।

মুজিব খুন হওয়ার পরপর OPS  উন্নয়ন কার্যক্রম আবার চালু করবার উদ্যোগ নেওয়া হলো। আগস্টের অভ্যুথানের পর IPA  ও INPOLSE স্নাতক কর্মকর্তার বিরাট রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেলেন। পাকিস্তান আমলেও তাঁদের এতো ক্ষমতা ছিলো না। কিন্তু  OPS /AID যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে একটা মুশকিল দেখা দিলো—মুজিবের মৃত্যুর এক মাস আগে গৃহীত আবুরেজক, সংশোধনীর ফলে সব OPS  কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে ব্রিটিশ সরকারের মাধ্যমে তখন একটা বিকল্প পথ বের করা হয়। অভ্যুত্থানের এক বছর পর বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাই কমিশনার বি জি স্মলম্যান এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব সালাউদ্দিন আহমদ এবং সাহায্য সমঝোতা স্বাক্ষর করেন। এই সমঝোতা মোতাবেক ‘পুলিশ টেলিযোগাযোগ উন্নয়নে ৭,২০,০০০ পাউন্ড ব্রিটিশ সাহায্য পাওয়ার কথা। মূল OPS /AID স্কীমের তৃতীয় পর্যায় বাস্তবায়ন করার জন্য এই পরিমাণ অর্থই দরকার ছিলো। মার্কিন কংগ্রেসের কাছ থেকে যে অর্থ আদায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো, সেটা ব্রিটিশ বিদেশী সাহায্য তহবিল হতে সরবরাহ করা হলো। বিলেতের পালার্মেন্টে তো আর আবুরেজক সংশোধনী নেই যে বিদেশী নিরাপত্তা সহায়তার উপর কোন শর্ত আরোপিত হবে। সে সময় Bangldesh Times—এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামাঞ্চলের সকল থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির সাথে সরাসরি রেডিও যোগাযোগের একটি প্রাথমিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের পুলিশের করায়ত্ত হবে। সেই সাথে ঢাকার সাথে নিকটস্থ জেলার প্রধান থানাগুলোর রাত্রিকালীন উপরি VHF যোগাযাগে স্থাপিত হবে। কারিগরী সহায়তা কার্যক্রমের অধীনে ব্রিটিশ সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে অভিজ্ঞ উপদেষ্টা সেবাও সরবরাহ করবে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ছাড়াও সৌদী সরকার এবং শাহ শাসিত ইরানও মুজিব—উত্তর বাংলাদেশের প্রতি তাদের নবজাগ্রত অগ্রহে কোন রাখঢাকের তোয়াক্কা করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ অসুবিধের জন্য দেশটা বাইরে খানিকটা সংযম দেখাতে বাধ্য হওয়ার পর এই যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব নিয়ে নিলো—এটা অস্বাভাবিকও নয় অপ্রত্যাশিতও নয়। সত্যি কথা বলতে কি, পঞ্চাশ দশকে মালয়ে জরুরী অবস্থার সময় থেকেই ব্রিটিশ সরকার রবার্ট থমসন ও অন্যান্য স্যাণ্ডহাস্টর্ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে উপনিবেশাত্তের অন্তঘার্ত—নিরোধ বিজ্ঞান উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে। ১৯৫০ ও ১৯৬০—এর দিকেই কমনওয়েলথ তৃতীয় বিশ্বের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাজে অভিজ্ঞ করে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করে—তখনও যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে অতোখানি জড়িয়ে পড়েনি। সফদারের মতো ব্যক্তির সেই ১৯৬৩ তেই বিলেতে এবং তারও আগে ১৯৫৪ তে ক্যানাডায়… নিরাপত্তা গোয়েন্দাবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

OPS টেলিযোগাযোগ গ্রিড সমাপনের অঙ্গীকার করার এক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের নিরাপত্তা সহায়তায় বৃহত্তর দায়িত্ব গ্রহণ করলো। ঢাকায় বিলেত থেকে একটি বিশেষ সামরিক মিশনের আগমন ঘটলো। আগস্টে একটা অভ্যুত্থানে মুজিব নিহত হবার পর ১৯৭৫—এর নভেম্বরে একটা সম্পূর্ণ অতর্কিত মার্কসবাদ—ঘেষা বিদ্রোহ ঘটে।

সেনাবাহিনীর সাধারণ্যে অবিশ্বাস্য সমর্থন পায়। এই ঘটনা পাচাত্যের শক্তিসমুহ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সম্পূর্ণ স্তম্ভিত করে দেয়। পাশ্চাত্যের শক্তি সমূহ উপলব্ধি করলো যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তাদের সামরিক যোগাযোগ ও সূত্র অত্যন্ত সামান্য। পুলিশ ও জাতীয় গোয়েন্দা সমাজে পাকিস্তান আমলে যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিলো স্বাধীনতার পর তা মোটামুটি অক্ষত রয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের ফলস্বরূপ বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত তরুণ নেতৃত্ব তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার সম্প্রদায়ে অত্যন্ত নগণ্য ও নিম্ন পর্যায়ে অবস্থিত ছিলো। ফলে পাকিস্তান বা এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মার্কিন ও ইউরোপীয় যোগ সূত্র ও জ্ঞানের প্রতি তুলনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যক্তিত্ব, ক্ষমতাদ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন সবন্ধে ১৯৭৫ সালের মার্কিন ও ইউরোপীয় ধারণা অত্যন্ত ধোঁয়াটে ছিলো। জানা গেছে যে ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টাদলের আগমনের উদ্দেশ্য ছিলো এই ত্রুটি মেরামত করা। তবে এদের অগমন নিয়ে তর্ক উঠেছিলো। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে মিশনের আগমনের উপর আলোচনা সেন্সর করা হলেও Guardian—এর দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা সারমন উইনচেস্টার ঢাকা থেকে ১৯৭৭—এর ২০ ডিসেম্বর প্রতিবেদনে বলেনঃ

“কিছু ব্রিটিশ সাহায্য কার্যক্রমের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন যে এ ধরণের সাহায্য জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক একনায়কতন্ত্রকে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনে সহায়তা করছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর জন্য ব্রিটিশ সহায়তা এবং বমার্ সীমান্তের কাছাকাছি একটি প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকার বিতর্কিত উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্রিটিশ অংশগ্রহণ বিশেষ ভাবে সমালোচিত হচ্ছে।

প্রতিক্ষেত্রে কার্যক্রমের বিরোধীরা খেদ জানাচ্ছেন যে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণকে সাহায্য না করে ইংরেজ সরকার এমন একটা শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে যারা বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা, তড়িৎ সিদ্ধান্তে মৃত্যুদণ্ডদান এবং বাকস্বাধীনতা হরণ ইত্যাকার অপকর্মে লিপ্ত। পশ্চিমা সরকারগুলোর যাদের সত্যিই সাহায্য করা উচিত সেই জনগণই অনেক ক্ষেত্রে এসব অপকর্মের শিকার।”

“যে সাহায্য কার্যক্রমগুলো বির্তকের সূত্র পাত করেছে সেগুলো বাংলাশের প্রাপ্ত সাহায্যের তুলনায় এমন কিছু বেশী নয়। একটি প্রকল্পের ব্যয় ১,৭৫,০০০ পাউন্ড। এটি বিদেশ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প উদ্দেশ্য বাংলাদেশের পুলিশের জন্য রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা। ঠিকাদার কোম্পানী Marconi কিছু, VHF স্টেশন স্থাপন করছে। এর ফলে ঢাকায় জাতীয় সদর দফতরের সাথে সারা দেশের পুলিশ যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবে।”

“দ্বিতীয় পরিকল্পনায় ব্রিটিশ সরকারের প্রায় কিছুই খরচ হয়নি। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের অদ্ভুত অগ্রাধিকারবোধ প্রতিফলিত হয়েছে—’আগে আইন শৃংখলা, পরে সত্যিকারের সাহায্য। আটজন উর্দ্ধতন সামরিক অফিসার, ছয়জন সেপাই—এদের মধ্যে একজন SAS কর্নেল—একজন নৌসেনা, একজন বিমানবাহিনী অফিসার—এদের দেশের রাজধানীর উত্তরে একটি স্টাফ কলেজ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।”

“একটি আন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, সমস্যাটা কি জানেন, এই যে বিদেশের সংবাদপত্রগুলো বাংলাদেশকে শুধু, দুর্ভিক্ষ ও বন্যার দেশ হিসেবে দেখিয়েছে—সেটা একটু বাড়াবাড়ি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে দেশটা একটা অত্যন্ত কঠোর সামরিক একনায়কত্র দ্বারা শাসিত। এখানে কারাগারে হাজার হাজার রাজবন্দী আছে। (১৯৭৭—এর) অক্টোবরের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর ২২৫ জনেরও বেশী লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একটি বিলেতী সাহায্য সংস্থার উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, Òআইন—শৃংখলা রক্ষার প্রতি ইংরেজদের অন্ধ গোঁ আছে। এরা মনে করেন, বোতাম টিপলেই পুলিশ হাজির করতে না পারলে বা সেনাবাহিনী যদি অন্তর্ঘাত বিরোধী তৎপরতায় ঝানু না হয়, তবে আহার, বাসস্থান বা কাপড়ের জন্য টাকা ঢালা বৃথা। আমরা এরকম ধারণার সাথে একমত নই। ক্ষুধার্তের জন্য আহার বেশী জরুরী। পলিশের জন্য রেডিও বা সেনাবাহিনীর জন্য রাস্তাঘাট পরে হলেও চলতে পারে। অন্তত বিলেতের করদাতাদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকা উচিৎ।Ó

[‘Where Braitin May Be Aiding an Armed Dictatorship’,The Guardian,20 December 1977]

সামরিক সরকার গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে এরকম খবর আসার পর উইনচেস্টারের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৯৭৮—এর মার্চে বোম্বাইয়ের Weekly—তে ব্রিটিশ সামরিক মিশনের আরো খবর ছাপা হয় এই সূত্রের মতেঃ

“১৯৭৭—এ জুলাইয়ে কর্ণেল এ গিবসনের নেতৃত্বাধীন ৮ সদস্য বিশিষ্ট ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টাদল ঢাকায় এসেছে। গিবসন মিশনের লোক দেখানো উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকার কাছে সাভারে একটা সামরিক স্টাফ কলেজ স্থাপন করা। ১৯৭২— এ এখানেই ভারতীয় সামরিক উপদেষ্টা মুজিবের রক্ষী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়। যে কথাটা সাধারণভাবে জানা জানি হয় তা হলো গিবসনের উপদেষ্টাদলকে দেশে ঢোকার অনুমতি দানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রচণ্ড আপত্তি ছিলো। সেপ্টেম্বর আর অক্টোবরের বিদ্রোহ দুটির যে মূল কারণসমূহ তার সাথে অন্ততত আংশিকভাবে ব্রিটিশ সামরিক মিশনের প্রসঙ্গটি যুক্ত বলে অনেকের বিশ্বাস। ১৯৭৫—এর ৭ নভেম্বর যে সিপাহী বিদ্রোহ হয় তার ১২ দফা দাবীর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দাবী ছিলোঃ সামরিক বাহিনীতে ঔপনিবেশিক নিয়ম—কানুনের সম্পূর্ন উচ্ছেদ। আজ বিদ্রোহের মাত্র দেড়’র পর একটি ব্রিটিশ সামরিক প্রশিক্ষণ মিশন বাংলাদেশে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে।”

“গিবসন মিশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আপত্তি হচ্ছে এই যে, অভিযোগ করা হচ্ছে যে এদের মূল উদ্দেশ্য প্রশিক্ষণ নয়, গোয়েন্দাতথ্য সংগ্রহ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মহলে গিবসন ও তাঁর ইউনিটের অন্যান্য সদস্যদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর Special Air Services(SAS) ব্রিগেডের প্রবীণ সদস্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। SAS হচ্ছে ইংরেজ সেনাবাহিনীর চৌকশ প্রতিরোধ—বিরোধী ইউনিট। রবার্ট থমসনের ‘মালয় জরুরী কৌশল’—এর উত্তরাধিকার এই ইউনিটটি বর্তমানে ওমান, মালয়েশিয়া, উত্তর আয়ারল্যাণ্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় তৎপরতায় জড়িত। প্রাক্তন SAS সদস্যদের ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে এঙ্গোলার গৃহযুদ্ধে এবং রোডেশিয়ার সেনাবাহিনীতে দেখা গেছে। একজন ওয়াকিবহাল বাঙালী জানান, ‘১৯৭৫—এর নভেম্বরের অভ্যুত্থান পশ্চিমা দেশগুলোকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলো। ওরা বুঝতে পেরেছিলো যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী সূত্রের ওপর এতোদিন নির্ভর করার ফলে ওদের (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্বন্ধে) জ্ঞান কি পামান্য। বাংলাদেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একথাটা সাধারণভাবে বিশ^াস করা হয় এবং একান্ত আলাপও হয় যে ব্রিটিশ সামরিক মিশনের আসল উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমা গোয়েন্দা সমাজের জন্য গোটা সামরিক সার সমাজের উপর গোয়েন্দা তথ্যের নথি প্রস্তুত করা। অর্থাৎ আগামীতে জিয়ার পতন হলে কে পরবর্তী পশিচমঘেষা আয়ুব খাঁ হবেন, সেটা আন্দাজ করবার ক্ষমতা গড়ে তোলা। তবে আবু তাহেরের মতো মার্ক্স’বাদীদেরও এরা সনাক্ত করতে চান, জানতে চান রাজনৈতিকভাবে কৈ নির্ভরযোগ্য। সেটা লণ্ডনে অথবা পেন্টাগনের অফিসে বসে বোঝা সম্ভব নয়। কম্পিউটার ও সেটা বলে দেবে না। ব্যক্তিগত যোগাযোগেই শুধু তা জানার একটা সম্ভাবনা থাকে।”

NSI—এরউত্থান

মুজিবের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সার্ভিসের উপর মহলে একটা নীরব, অনেকটা অগোচর অথচ অত্যন্ত অর্থবহ পরিবর্তন ঘটলো। এক অর্থে ১৯৫৮ সালের পর এমনটি আর হয়নি। ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আয়ূব খাঁর অভ্যুত্থান যে শুধু, সামরিক খাতে বিশাল ব্যয়বৃদ্ধি সুচিত করেছিলো তাই নয়, সেই সাথে তখন সকল অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের কর্তৃত্ব, রাষ্ট্রীয় কপোরেশন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও মূলত সামরিক অফিসার ও তাদের পরিবারের কুক্ষি গত হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আরব আমলে অসৎ সুবিধের অধিকার মোটামুটি উর্দ্ধতন সামরিক মহলেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আন্তর্জাতিক সাহায্য ও বিদেশী চুক্তির মহাভোজসভার উচ্ছিষ্টমাত্র পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভাগ্যে জুটতো। কিন্তু ‘৭৫—এর পট পরিবর্তনের পর পুলিশ ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থার অপূর্ব অর্থনৈতিক উত্থান ঘটলো। পাকিস্তান আমলে কোন পুলিশ বা গোয়েন্দা কর্মকতার্ পূর্ণ সচিবের পদমর্যাদা ভোগ করেননি। গোয়েন্দা প্রধান বরাবর স্বরাষ্ট্র সচিবের কতৃর্ত্বাধীন ছিলেন। কিন্তু আগস্ট অভ্যুত্থানের পর শুধু যে NSI—এর মহাপরিচালক হিসেবে সফদারকে পূর্ণসচিবের পদমর্যাদা দেওয়া হলো তাই নয়, সেই সাথে আরো বেশ ক জন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারও এ ধরণের পদোন্নতি ঘটে। পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রীয় কপোর্রেশন ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার গুরত্বপূর্ণ সব পদ দখল করে বসেন। বাংলাদেশের মতো একটা পরনির্ভরশীলদেশ, যেখানে দেশ শাসনের ৫০% ব্যয়ভার বিদেশীরা বহন করে, সেখানে বিদেশী অর্থ ও সম্পদ আনাগোনার পথগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজস্ব প্রভাববলয় বিস্তৃত করার অর্থনৈতিক ভিত্তি হতে পারে।

১৯৭৫—এর ঘটনাবলীর পর বাংলাদেশের পুলিশ ও নিরাপত্তা সাভির্স ‘অপ্রতিহত গতিতে নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারিত করেছে। আই জি পুলিশ এ এইচ নুরুল ইসলাম—ইনি ১৯৬৮’র আন্তজার্তিক পুলিশ একাডেমী (IPA ) স্মাতক—’ DIT দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক কালীন অতিরিক্ত আই জি পুলিশ কে সি মহিউদ্দিন ‘কসকর’ এর চেয়ারম্যান হয়ে যান। ত্রাণ ও পুনবাসন মন্ত্রণালয়ে ১৯৬৮—এর IPA   স্মাতক আমীর খসরু সতীর্থদের মতো পূর্ণ সচিবের পদমর্যাদা করেন। অন্যান্য পুলিশ/গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও দ্রুত পদোন্নতি করেছেন, যেমন সালাউদ্দিন আহমেদ, যিনি বি, জে, এম, সি’র চেয়ারম্যান হয়ে যান। একই সময়ে মৎস্য, পশুপালন ও বন মন্ত্রণালয়ের  র্কতৃত্ব গ্রহণ করেন। আরেকজন প্রাক্তন আই জি পুলিশ আব্দুল খালেক। এ ছাড়া আব্দুর রহিমের কথা আমরা আগেই বলেছি। ইনি ১৯৭৬—৭৭ সালে সংস্থাপন বিভাগের র্কতৃত্ব গ্রহণ করেন। সারাদেশের আমলাতন্ত্রের নিয়ন্তা এই বিভাগ। ১৯৭৮—এ রহিম প্রশাসনিক স্টাফ কলেজের পরিচালক হয়ে যান। এখান থেকে সকল আমলা ও অতি সম্প্রতি উর্দ্ধতন সামরিক অফিসাররা বিশেষ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।  অর্থাৎ সাবির্কভাবে ১৯৭৫—এর পর খুব নীরবে পুলিশ ও গোয়েন্দা ক্যাডার নিজেদের অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থায় নিয়ে এসেছে।

কিন্তু এতো কথা বলার পরও যে কথাটা অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে তা হলো নিরাপত্তা সংস্থার উত্থানের সাথে সাথে আত্মীয়তা সূত্রে সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যবসায়িক সম্পর্কের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির কথা। এ সময়কার বেশ কটা বড় কেলেংকারীর একটির সাথে মার্কিন সংস্থা Continental Grain—এর এজেট শফি আহমদ চৌধুরী জড়িত। তিনি দেশের একজন অত্যন্ত উচু গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকতা ই এ চৌধুরীর ভাই। বাংলাদেশের একজন উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকতার্Ñযনি এদের পারিবারিক ব্যবসা সম্বন্ধে খুব ভাল খবর রাখেন,তাঁর মতে,Òকাঁচা টাকার হিসেবে শফি চৌধুরী বাংলাদেশে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তাঁকে প্রায়ই বাংলাদেশের ‘রকেফেলার জহুরুল ইসলামের সাথে তুলনা করা হয়। জহুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে উত্তরাঞ্চলের একটি জলসেচ প্রকল্পের ব্যাপারে ভাঁওতা দিয়ে তিনি বিশ্বব্যাংকের তহবিল থেকে অতিরিক্ত ৪ মিলিয়ন ডলার পকেটস্থ করেন। ১৯৭৮—৭৯ সালে জহুরুুল ইসলাম জেঃ জিয়াউর রহমানের নতুন রাজনৈতিক সৃষ্টি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন বড় আর্থিক পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছেন। জহুরুল ইসলামের কোম্পানী নাভানা ট্রেডার্সের অন্তত দুজন ভূতপূর্ব ডিরেক্টর, জাকারিয়া চৌধুরী ও হাবিবুল্লাহ খান জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। ১৯৭০ এর শেষ দিকে বাংলাদেশ একটা পরিচিত গং অনুসরণ করতে লাগলো—দেশটা এখন চালাচ্ছে সামরিক ও গোয়েন্দাসংস্থা নিয়ন্ত্রাধীন একটি অত্যন্ত পরনির্ভরশীল, দুনীর্তিপরায়ণ, ডানপন্থী প্রশাসনÑসাথে আছে জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নের গৎ বাঁধা প্রাত্যহিক গণতোষ গলাবাজী। অথচ বিরাট ত্যাগ ও গভীর আশা বিজড়িত স্বাধীনতার প্রথম দশক যে স্বপ্ন জাগিয়েছিলো, আজকের বাস্তব তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

- Advertisement -
spot_img

Latest articles

Related articles

spot_img