
মুজিব শাসনামল (১৯৭২-৭৫)
ক. সরকার গঠন

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিত। এই সরকারের নেতৃত্বে একটি সফল মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পাকিস্তানি বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসেন। পরদিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর এক আদেশবলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার স্থলে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং তিনি হন এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। শীঘ্রই ২৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা ঘোষণা করা হয়, যাতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্প এবং তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হলেন দেশের রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়লাভের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৬ই মার্চ পূর্বের মন্ত্রিসভায় সামান্য রদবদল করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটিমাত্র বৈধ জাতীয় রাজনৈতিক দল সৃষ্টি এবং সংসদীয় ব্যবস্থার স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হলে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হন। ১৫ই আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সে পদেই বহাল ছিলেন।
খ. সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ সমূহ –
বঙ্গবন্ধু সরকারকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো নিম্নরূপ—
১.যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন: ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের প্রায় সকল যোগাযোগব্যবস্থা, সমুদ্রবন্দর ধ্বংস বা ব্যবহারের অনুপযোগী করে দেয়। স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, ঘরবাড়ি, খাদ্যগুদাম, গ্রামের হাটবাজার জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস বা বিনষ্ট করে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হন, ১ কোটি বাঙালি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে, অনেক মুক্তিযোদ্ধা চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। দায়িত্বভার গ্রহণের পরপর বঙ্গবন্ধু সরকারকে এসব পুনর্গঠন- পুনর্বাসন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যেসব সেনাসদস্য বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল, তাদের সে দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতে হয়।
২. অর্থনৈতিক সমস্যা: ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্যন্ত হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খাদ্য মজুত বলতে কিছুই ছিল না। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষয়- ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১.২ লাখ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লাখ লাখ লোক অনাহারে মারা যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এর ওপর ৭২ সালের দীর্ঘস্থায়ী খরা, ৭৩ সালের প্রলয়ংকরী সাইক্লোন এবং ৭৪ সালের আরব- ইসরাইল যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি—এসবের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর পড়ে।
৩. আইনশৃঙ্খলা সমস্যা: মুক্তিযুদ্ধ শেষে অনেকে অস্ত্র জমা দেন। তারপরও বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়ে যায়। ফলে সশস্ত্র ডাকাতি, লুটতরাজ, ছিনতাই ইত্যাদি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রত্যাশা যে আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, তা সহজে পূরণীয় ছিল না। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করে। এর মোকাবিলায় পুলিশ বাহিনী ছিল অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ।
৪. সন্ত্রাসী তৎপরতা : স্বাধীনতার পর বাম নামধারী চীনপন্থী কিছু গোপন সংগঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’ এবং মুজিব সরকারকে রুশ-ভারত কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া ‘অবৈধ সরকার’ বলে প্রচার করতে থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ যে স্বাধীন হয়েছে, তা-ই স্বীকার করে নেয় নি। এরা সংসদীয় রাজনীতিতে আদৌ বিশ্বাসী ছিল না। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তাঞ্চল সৃষ্টিসহ সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতা দখলের নামে এসব উগ্র সংগঠন গোপন তৎপরতা শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৫ মাসেই এদের হাতে ৬০টি থানা আক্রান্ত হয় এবং সকল অস্ত্র লুট হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি দল আওয়ামী লীগের ৪ জন এমপিসহ ৩ হাজার নেতা-কর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে হত্যার শিকার হন। এককথায় এরা সরকারে বিরুদ্ধে একধরনের অঘোষিত যুদ্ধ ছুড়ে দেয়।
৫. জাসদের উত্থান : ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠা মুজিব সরকারের জন্য এক নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। জাসদের উদ্যোক্তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ধারা থেকে উঠে আসে এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে দলটি দ্রুত ছাত্র-তরুণ সম্প্রদায়কে বিপুলসংখ্যায় আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের অনেকে সরকারের বিরুদ্ধে একটি জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জাসদের ব্যানারে সমবেত হয়। শীঘ্রই জাসদ সাৱা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত ও অস্থিতিশীল করে তোলে ।
৬.স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র : মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তি ৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও স্বাধীনতার পর তারা নতুন এ রাষ্ট্র এবং মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। উৎপাদন ও কটনব্যবস্থা ব্যাহত এবং সরকারকে অসফল করার উদ্দেশ্যে এরা নানা নাশকতামূলক তৎপরতায় মদদ দেয়। ১৯৭৪ সালে তীব্র খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেওয়া সত্ত্বেও চুক্তি মোতাবেক খাদ্যবোঝাই বিদেশি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি এসে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে ফিরে যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে বিদেশি ষড়যন্ত্র যুক্ত ছিল, তা এখন স্পষ্ট।
গ. সরকারের ভূমিকা বা সাফল্য –
বঙ্গবন্ধুর সরকার মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। এ সময়ে সরকার যেসব সাফল্য
অর্জন করতে সক্ষম হয়, তা নিম্নরূপ—
১.যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃস্থাপন : সরকার হার্ডিঞ্জ, ভৈরব ব্রিজসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরি, ১৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগি, ৪৬০টি বাস, ৬০৫টি নৌযান ক্রয় এবং চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর থেকে মাইন উদ্ধার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা চালু করে।
২. পুনর্বাসন : বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি লোককে দক্ষতার সঙ্গে পুনর্বাসন করে। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্যদান, নির্যাতিত মা-বোনদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব গ্রহণ এবং পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার্থে বিদেশে প্রেরণসহ অন্যান্য ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করে। সরকার পাকিস্তানে আটকে পড়া ১ লাখ ২২ হাজার বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে।
৩. ভারতীয় সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানো : মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর থেকে ৩ মাসের কম সময়ের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিশ্বে একটি নজির স্থাপন করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের কারণেই এত স্বল্প সময়ে এটি করা সম্ভব হয়।
৪. সংবিধান প্রণয়ন : দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি সংবিধান প্রণয়ন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিশেষ কৃতিত্ব। উল্লেখ্য, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৯ বছরেও সে দেশে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয় নি।
৫. সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন : দেশে ফিরে এসে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের পর কালবিলম্ব না করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার স্থলে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল একটি বাস্তবানুগ রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এর ফলে সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে এ দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়ন ঘটে।
৬. জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোয়, বাংলাদেশ নয়—বিরোধী মহলে এ রকম গুঞ্জন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সরকার গঠনের মাত্র ১৫ মাসের মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন পেয়ে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট লাভ করে।
সারণি-১ : ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ফলাফল
দলের নাম | প্রার্থীসংখ্যা | আসন লাভ | ভোটপ্রাপ্তি |
আওয়ামী লীগ | ৩০০ | ২৯২ | ৭৩.১৭ |
ন্যাপ(মোজাফফর) | ২২৩ | — | ৮.৫৯ |
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) | ২৩৬ | ১ | ৬.৫৯ |
ন্যাপ (ভাসানী | ১৬৯ | — | ৫.৪২ |
স্বতন্ত্র ও অন্যান্য | ১৫০ | ৬ | ৬.৩৪ |
মোট | ১০৭৮ | ২৯৯* | ১০০ |
উৎস : Talukder Maniruzzaman, Bangladesh Revolution. p. 156(Table 8)
* একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় ওই সিটে নির্বাচন স্থগিত থাকে। পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হন।
৭. জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী পুনর্গঠন : বঙ্গবন্ধু সরকার জাতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ সদ্য স্বাধীন দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জাতীয় মর্যাদায় পুনর্গঠিত করে। কুমিল্লায় দেশের প্রথম সামরিক একাডেমি স্থাপন করা হয়। পুলিশ, বিডিআর, আনসার ও বেসামরিক প্রশাসনের অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়।
৮. সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ : স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। এ ছিল মুজিব সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কিন্তু পরবর্তী শাসনামলে তা আর রক্ষা করা হয় নি।
৯. ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঠেকানো : যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ২ কোটির মতো লোক মারা যাবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে আশঙ্কা করা হয়েছিল। নানা প্রতিকূল অবস্থার কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দিলেও ভয়াবহ রূপ নেওয়ার পূর্বেই সরকার তা ঠেকাতে সক্ষম হয় (সরকারি মতে, এ দুর্ভিক্ষে ২৭ হাজার ৫০০ লোক প্রাণ হারায়)।
১০. শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি : বঙ্গবন্ধু সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী ও যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিল করে গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ ৭৩ প্রণয়ন করে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও কয়েক লাখ শিক্ষককে সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দান, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বহু স্কুল- কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ এ সময়ে দেওয়া হয়।
১১. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাফল্য : বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে। শুরু থেকে বাংলাদেশের জন্য জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ ছিল একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ কমনওয়েলথের, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানসহ বিশ্বের ১৪০টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হয় । বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই ৪ হাজার কিউসেক পানি প্রাপ্তির ব্যবস্থাসহ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দান করে বাঙালিদের মহিমান্বিত করেন। বিশ্বশান্তি ও বিশ্বমানবতার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালে তাঁকে ‘জুলিও কুরি’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
ঘ. মুজিব শাসনের অবসান
১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একটিমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল গঠনের পর দ্রুত দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাস পায়, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঠিক এমনই সময় সংঘটিত হয় ১৫ই আগস্টের নির্মম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। যদিও সেনাবাহিনীতে চাকরিরত এবং বিভিন্ন সময় চাকরিচ্যুত কিছু সেনাসদস্য কর্তৃক এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তবু এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত
দেশি-বিদেশি শক্তি ও এদের প্রতিক্রিয়াশীল সহযোগী গোষ্ঠীর যে সংশ্লিষ্টতা ছিল, তা এখন বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়। এ ছিল একটি ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একটিমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল গঠনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সাময়িক বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। বস্তুত মুজিব হলেন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—এ দুই পরাশক্তির মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই জনিত (Cold war) বিশ্বরাজনীতির নির্মম শিকার।
তথ্যনির্দেশ –
১. Talukder Maniruzzaman, Bangladesh Revolution, p. 165 হারুন-অর- রশিদ, মূলধারার রাজনীতি, পৃ. ১৫৫-১৭৩
২. Rehman Sobhan, “Politics, Food and Famine in Bangladesh,” Economic and Political Weekly (Bombay). 1 December 1979
৩. দ্রষ্টা Obaidul Huq, Bangabandhu, pp. 143-49 (Appendix-V)
