শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড : দুই বোনের নির্বাসিত জীবন

হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। তিনি এ দেশের মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন। তার বিনিময়ে স্বাধীন দেশে কেউ তার রক্ত ঝরাবে, এটি ছিল তার কাছে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় বিষয়। যার কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েও অবাধে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, সর্বত্র যাতায়াত করেছেন নির্দ্বিধায়। তার পরিবারের মানুষজনও রাষ্ট্রীয় প্রটোকল নিতে চাইতেন না। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল সহ পরিবারের কেউই চাকচিক্য পছন্দ করতেন না। শিশু শেখ রাসেল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনের সড়কে একা একা সাইকেল চালাত।

 

বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসা স্মৃতিকথায় লিখেছেন, শেখ রাসেল স্কুলে যাওয়ার সময়ও তার সঙ্গে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী থাকত না। কেবল শিশু রাসেল নয়, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাই এভাবে চলাফেরা করতেন। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি বঙ্গভবনে থাকেননি। অনেক শুভাকাক্সক্ষী তাকে নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনে যেতে বললেও তিনি যাননি। তিনি মনে করতেন, বঙ্গভবনে থাকলে তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হবে। স্বভাবতই তিনি জনগণ থেকে দূর থাকতে চাননি। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান। তার লেখা ‘ফ্যান্টম্স্ অব চিটাগং’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘এবারও আমি লক্ষ করলাম, তার বাসায় কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময়ে যখন-তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইত। তার সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোনো বাছবিচার নেই।

 

এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, ‘আমি জাতির জনক, দিন বা রাতে কোনো সময়েই তো আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।’ বঙ্গবন্ধুর এমন সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে নিয়েছিল পঁচাত্তরের ঘাতকরা। ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এ কথা বঙ্গবন্ধুকে জানালেও তিনি গুরুত্ব দেননি। জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা আর এন কাও ১৯৮৯ সালের এপ্রিলের শেষদিকে সানডের সংখ্যায় লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি নিজে ঢাকায় এসে মুজিবকে এ ষড়যন্ত্রের খবর দিই। কিন্তু মুজিব সেটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা আমার সন্তান। আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।

- Advertisement -

 

সবচেয়ে বিশাল ও ভারি যে লাশটি বাংলাদেশ নিজের বুকের কবরে বয়ে চলেছে, সেটি মুজিবের লাশ’—হুমায়ুন আজাদ এ একটি উক্তির মাধ্যমেই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রগাঢ়তা এবং ব্যাপকতা উল্লেখ করা যায়। বিশ্বের ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অসংখ্যবার ঘটেছে, ভবিষ্যতেও হয়তবা ঘটতে পারে কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রভাব সারা বিশ্বের মেহনতি এবং শোষিত মানুষের কষ্ঠকে বিদ্ধ করে দিয়েছিল, বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বরকে। বিশ্বের নিপীড়িত এবং নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হিসেবে শেখ মুজিবকে দেখা হতো। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিশ্বকে তার বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি শোষিত মানুষের জন্য আমরণ সংগ্রাম করে যাবেন এবং নিজের জীবন দিয়ে বক্তব্যের যথোক্তি প্রমাণ করেছেন। মৃত্যু-অবধি গরিব দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল ছিলেন। আর তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলার জমিনে। নিষ্ঠুর থেকেও নিষ্ঠুরতম ছিল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি। ইতিহাসের অন্যতম রাজনৈতিক এবং জঘন্য হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় শেখ মুজিবকে পুরো পরিবারসহ হত্যার মধ্য দিয়ে।


ওইদিন বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বড় ছেলে শেখ কামাল, দ্বিতীয় ছেলে শেখ জামাল, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী পারভীন জামাল রোজী, বঙ্গবন্ধুর সেজ বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও সেরনিয়াবাতের ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু ও ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর মেজ বোনের বড় ছেলে শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর স্ত্রী বেগম আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ মোট ২৬ জনকে হত্যা করে ঘাতকরা।

 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা তার স্বামীর সঙ্গে ছিলেন ব্রাসেলসে শেখ রেহানার সঙ্গে। কঠিন সময়ে পরিবারকে আগলে রেখেছেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া। জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর পরামর্শে তিনি বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ভারতে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে ড. ওয়াজেদ মিয়া ভারত সরকারকে লিখেছেন, “আমি আমার ভগ্নিপতি রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশুপুত্র জয়, শিশু কন্যা পুতুল এবং ভারত সরকারের কাছে শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও নিরাপত্তার জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” [সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু তথ্য, লেখক: এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পৃষ্ঠা: 26]

 

১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী ইন্দিরা গান্ধীর তৎকালীন সরকার শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আগস্ট মাসে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার জাম্বো জেটে দিল্লির পালম বিমানবন্দরে পৌঁছান। তাদের প্রথমে দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি ফ্ল্যাটে এবং পরে ইন্ডিয়াপেটের কাছে পান্ডারা রোডের একটি সরকারি বাড়িতে একটি দোতলার ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারত সরকার ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ লাভ করেন। ফেলোশিপের শর্ত অনুযায়ী এমএ ওয়াজেদ মিয়া ভারতীয় মুদ্রায় বাড়ি ও অফিস ভ্রমণ সুবিধা ছাড়াও সাম্প্রতিক সব নয় আজকের পাঠক দৈনিক ভাতা ছিল ৭২.৫০ টাকা। এভাবেই কেটেছে জাতির জনকের দুই কন্যার সাদামাটা শঙ্কিত জীবন। দেশে বিদেশ খবর জানার জন্য ছিল একটাই ট্রানজিস্টর।

 

শেখ হাসিনাদের প্রথমে রাখা হয় ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউজ’-এ। পরে তাদেরকে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং তাদের প্রতি তিনটি পরামর্শ দেয়া হয়। প্রথমত, তারা যেন বাড়ির বাইরে না যান; দ্বিতীয়ত, তারা যেন সেখানে কারো কাছে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় না দেন; তৃতীয়, দিল্লিতে কারো সঙ্গে যেন যোগাযোগ না রাখেন।
‘র’-এর একজন প্রাক্তন অফিসার নাম না প্রকাশের শর্তে বলছিলেন, “শেখ হাসিনার নিরাপত্তার জন্য দু’জনকে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সত্য ঘোষ নামের এক ইন্সপেক্টর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল। অন্যজন ছিলেন ১৯৫০ সালের ব্যাচের ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস অফিসার পি কে সেন।

 

- YouTube -

ঘটনাচক্রে ইন্সপেক্টর সেনকে ‘কর্নেল’ হিসাবে, আর পদাধিকার বলে তাঁর থেকে অনেক উঁচুতে, আইজি র‍্যাঙ্কের অফিসার পি কে সেনকে ‘ইন্সপেক্টর’ হিসাবে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল।এই দু’জন অফিসারই ছায়ার মতো শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকতেন। শেখ হাসিনার স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়াকে ১৯৭৫ সালের ১লা অক্টোবর পরমাণু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছিল।

 

‘র’-এর ওই প্রাক্তন কর্মকর্তা বলছিলেন, “শেখ হাসিনার সব খরচ ভারত সরকারই দিত। যদিও সেটা খুব সামান্যই ছিল। টাকাটা কলকাতায় তাঁর এক পরিচিত চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে দেওয়া হত।” চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ হাসিনা যে দিল্লিতে আছেন, সেই খবরটা যাতে কেউ না জানতে পারে। তবে বাংলাদেশের সরকার তাঁর অবস্থান জেনে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান আর তাঁর স্ত্রী দেখা করতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার সঙ্গে।দুই বোন তাঁদের জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলেন। শেখ রেহানার সে বছরই দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলীর জন্য তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে তাঁর ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে নিরাপত্তা-জনিত কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিল।

 

শেখ হাসিনার দিল্লিতে কাটানো পৌনে ছয় বছরের বিশেষ গুরুত্ব হলো, ওই সময়টাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন নিজের মন শক্ত করতে, এবং দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে।১৯৭৫ সালে নিজের পরিবারের প্রায় সবাইকে হারানোর পরপরই বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারলে শেখ হাসিনা কী করতেন, আর বাংলাদেশের ৭৫-পরবর্তী ইতিহাসই বা কেমন হতো, তা আমাদের কখনোই জানার সুযোগ হবে না।তবে এটুকু বলাই যায়, ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি যে মানসিকভাবে শক্তিশালী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজ স্বদেশ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, এবং পরবর্তীতে ধরেছেন বাংলাদেশের হাল, সেই অধ্যায়ের ভিত রচিত হয় তার পৌনে ছয় বছরের দিল্লি জীবনেই।

 

১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে শুরু হয় নানা অরাজকতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার ধারাবাহিক অপচেষ্টা চলে। স্বাধীনতাবিরোধীরা উদার-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করতে উঠেপড়ে লাগে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, উদার-সংস্কৃতিমনাদের মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল হয়ে পড়ে কোণঠাসা। দেশে ফিরে আসতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধীরা। রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় পাকিস্তানের দোসরদের।পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ ঘোর অমাবস্যায় ডুবে থাকা এক জনপদের নাম। একটা সময় পর্যন্ত অবস্থা এমন ছিল যে, কোনো আশা নেই, ভালোবাসা নেই, আছে শুধু লোমহর্ষক হত্যা আর ষড়যন্ত্রের জাল বুননের নানা কাহিনী।

 

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮, এবং ১৯৮০ সাল নাগাদ একদিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় গড়ে ওঠা আন্দোলনের গতি বেগবান হয়, অন্যদিকে নেতৃত্বের দ্ব›দ্ব বা উচ্চাভিলাষের কারণে দলীয় ঐক্যে সংকট শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় ৩-৫ মার্চ। সেই সম্মেলনে দেখেছি, সারা দেশে দল গোছানোর দায়িত্ব পালন করে দলের আহ্বাায়ক ও সম্মেলনের সভাপতি বেগম জোহরা তাজউদ্দিন কিছুটা সামলে উঠলেও, শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সহধর্মিণী বেগম আমেনা মনসুর তখনও বেদনাভারে গভীরভাবে শোকার্ত, বিধ্বস্ত।তিনি কাতর কণ্ঠে দলের ঐক্য ধরে রাখার আকুল আহ্বান জানিয়ে বলেন: আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান বেঁচে থাকুক। সবার মধ্যে ঐক্য থাকুক, কোনো বিভেদ যেনো না আসে। তবে, নেতৃত্বের কোন্দল নিয়ে পত্র-পত্রিকায় তখন আওয়ামী লীগ ভেঙে যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো। কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিল ও সদ্য কারামুক্ত নেতা আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ নতুন কমিটি নির্বাচন করা হয়। কিন্তু, সম্মেলনের কয়েক মাসের মাথায় মিজানুর রহমান চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে পাল্টা কমিটি গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। অর্থাৎ ঐক্যের সংকট প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করে।

 

এভাবে ভিতরে ভিতরে কোন্দল-কলহে দলের ঐক্য টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মূলত সভাপতি পদ নিয়ে দলে অনৈক্য চরমে পৌঁছে। এহেন পরিস্থিতিতে আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৯৮১ সালের সম্মেলন। বরাবরের মতোন হোটেল ইডেনে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ই ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ অফিস ৯১, নবাবপুর থেকে ২৩.বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে এসেছে।

 

দল তখন চরম আর্থিক সংকটে। নেতাদের বলাবলি করতে শুনেছি সম্মেলনের সময় বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদের কখনো না খাইয়ে ছাড়তেন না। তাই, ঐতিহ্য মেনে চলতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় সম্মেলনস্থলেই। দুপুরের পরে সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনের সময় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হোটেল ইডেন আর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে আমাদের যাওয়া-আসা চলে। নেতা নির্বাচন করা নিয়ে দফায় দফায় কখনো আওয়ামী লীগ অফিসে, আবার কখনো নেতাদের বাসায় বাসায় মিটিং হচ্ছে। নেতারা আসছেন। মিটিং করছেন। অফিসে বসার জায়গা নেই। এভাবে ১৬ই ফেব্রুয়ারি সারাদিন, সন্ধ্যা কেটে যায়। অফিসের সামনের রাস্তায় বসে মুহূর্তে মুহূর্তে নানান গুজব শুনি নেতারা একমত হতে পারছেন না। দল ভাগ হয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি করার প্রস্তাব করা হয়েছে, কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। মনে সংশয় নিয়েও শেখ হাসিনার নাম সবার ভিতরে মুহূর্তেই নতুন আশার স ার করলো। অনেককে হাত তুলে আল্লাহ আল্লাহ করতে দেখেছি যাতে শেখ হাসিনা রাজি হন, যাতে দল ভেঙে না যায়। কর্মীদের মধ্যে ঐক্যের কী সেই আকুতি! এখানে, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্বৃত করা অত্যাবশক যে, ‘… নেতা নেওয়া যায়, কর্মী নেওয়া যায় না, তাদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক’। আজ শেখ হাসিনার বেলায়ও হুবহু তাই দেখলাম।

 

হঠাৎ সবাই নড়েচড়ে ওঠলো শেখ হাসিনা সভাপতি হতে রাজি হয়েছেন! আবদুর রাজ্জাক সেক্রেটারি। সে কী উল্লাস, সে কী উত্তেজনা, সে কী আনন্দের বন্যা! জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে মুখরিত ও উদ্বেলিত হয়ে ওঠলো পুরো বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ। নেতারা হোটেল ইডেনে চলে গেলেন কাউন্সিলরদের কাছে। আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।

 

ড. মিয়ার বইতে ওই বিবরণ আসে এভাবে: “১৬ই ফেব্রুয়ারি (১৯৮১) তারিখের সকালে লন্ডন থেকে ফোনে সংবাদ পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৩-১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে হাসিনাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর শেখ সেলিমও হাসিনাকে ফোনে একই সংবাদ দেন। এরপর ঢাকা ও লন্ডন থেকে আরও অনেকে টেলিফোনে হাসিনাকে অভিনন্দন জানান।” তিনি আরও লেখেন, পরের দিন দিল্লিস্থ অনেক সাংবাদিক শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মন্তব্য ও মতামত প্রকাশ করেন।এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের ওই সময়কার শীর্ষ নেতারা যান দিল্লিতে।

 

“২৪শে ফেব্রুয়ারি (১৯৮১) তারিখে ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, স্বামী গোলাম আকবার চৌধুরীসহ বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ দিল্লী পৌঁছান” – এভাবেই ঘটনাবলীর বর্ণনা করেন ওয়াজেদ মিয়া। তারা শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন বলেও জানান ওয়াজেদ মিয়া তাঁর লেখায়।এরপর ড. কামাল হোসেন ও সাজেদা চৌধুরী ছাড়া সবাই ঢাকায় ফিরে যান। “ড. কামাল হোসেন এবং বেগম সাজেদা চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল আমাদের পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করে হাসিনার ঢাকা ফেরার তারিখ চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করার জন্যে”, লেখেন ওয়াজেদ মিয়া।

 

তবে শেখ হাসিনার ঢাকা ফেরার বিষয়ে ড. কামাল হোসেন ও সাজেদা চৌধুরী মার্চের দুটো সম্ভাব্য তারিখ প্রস্তাব করলেও ওই তারিখের ব্যাপারে ওয়াজেদ মিয়ার আপত্তি ছিল।ওয়াজেদ মিয়ার বর্ণনায়, “এরপর মে মাসের ১৭ তারিখ ফেরার দিন চূড়ান্ত হয়। ১৬ তারিখে আওয়ামী লীগের আব্দুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে পুতুলকে নিয়ে দিল্লী থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে কোলকাতা পৌঁছান। এরপর ১৭ই মে তারিখে সন্ধ্যায় তারা কোলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান।”

- Advertisement -

কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

  • সাবস্ক্রাইব করুন তথ্যবহুল সত্য খবরের জন্য 

    You are our valued subscriber. We send weekly newsletter. NO SPAM

আরও পড়ুন