ক. সংবিধানে মৌলিক অধিকার সমূহ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে (অনুচ্ছেদ ২৬-৪৭) এ ধরনের বেশ কিছু মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে। সংক্ষেপে তা হলো নিম্নরূপ-
১. আইনের দৃষ্টিতে সমতা : সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান।
২. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার: আইনের আশ্রয় লাভ বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার। বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
৩. জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার: আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।
৪. চলাফেরার স্বাধীনতা : জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, এর যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
৫. সমাবেশের স্বাধীনতা : জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
৬. সংগঠনের স্বাধীনতা : জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
৭. চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা : প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকবে। এ ছাড়া আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকবে।
৮. পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা : আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো আইনসংগত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং যেকোনো আইনসংগত কারবার বা ব্যবসা পরিচালনার অধিকার থাকবে।
৯. সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা : (ক) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। (খ) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেক্ষেত্রে তাঁর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। (গ) নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে তাঁদের অনুকূলে রাষ্ট্র বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে।
১০. সম্পত্তির অধিকার : আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করার অধিকার থাকবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাবে না।
১১. গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।
১২. ধর্মীয় স্বাধীনতা : আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের এবং (খ) নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবহারে অধিকার থাকবে।
১৩. ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য প্রদর্শন না করা : কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী- পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।
১৪. নারী, পুরুষ বা অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান : নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভের সুযোগ থাকবে।
১৫. নারী, শিশু বা অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান : নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে।
১৬. জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধকরণ : সকল প্রকার জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধ, এবং এই বিধান কোনোভাবে লঙ্ঘিত হলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
১৭. গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ : (ক) গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না।এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। (খ) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করা হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাবে না। (গ) নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোনো আইনে কোনো ব্যক্তিকে ছয় মাসের অধিককাল আটক রাখার ক্ষমতা প্রদান করবে না।
১৮. বিচার ও দত্ত সম্পর্কে রক্ষণ : (ক) এক অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারিতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাবে না। (খ) ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন। (গ) কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। (ঘ) কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।
১৯. দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতা : প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো ব্যক্তি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যেকোনো অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালে প্রয়োজনে কোনো কার্য করে থাকলে সংসদ আইন দ্বারা সে ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করতে পারবেন।
খ. মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব
সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তির কল্যাণের জন্য যে রাষ্ট্র এটি তার নির্দেশক। মৌলিক অধিকার ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ। এ দ্বারা রাষ্ট্রের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকার যখন যা খুশি করতে পারে না। একমাত্র জরুরি অবস্থা ব্যতীত সচরাচর মৌলিক অধিকার খর্ব করা যায় না। এর সর্বোচ্চ গুরুত্বের কারণেই বাংলাদেশ সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে যে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল হয়ে যাবে। এ-ও বলা হয় যে, রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত [মৌলিক অধিকার] অসামস্য কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না। এককথায় মৌলিক অধিকার অর্থ নাগরিক স্বাধীনতা।
গ. মৌলিক অধিকার রক্ষা বা বলবৎ করার উপায়
সাংবিধানিক নিশ্চয়তা সত্ত্বেও মৌলিক অধিকার যে খর্ব হয় না তা নয়। জরুরি অবস্থায় তা হয় । প্রয়োজনে সংবিধানও পরিবর্তন বা সংশোধনযোগ্য। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারসহ যেকোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ দ্বারা সংসদের সার্বভৌমত্বকেই বোঝায়। এর অর্থ এই নয় যে সরকার যখন খুশি তখন সংবিধান সংশোধন বা মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে কিছু শর্ত বা নিয়মকানুন পূরণ করতে হয়। এটিও মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ। বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে যা বলা আছে তা হচ্ছে, Ôএই ভাগে প্রদত্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করিবার জন্য এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করিবার অধিকারে নিশ্চয়তা দান করা হইল। ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে হাইকোর্ট বিভাগ যেকোনো মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ বা নির্দেশ দান করতে পারেন। তবে নাগরিকদের সচেতনতা ও সংঘবদ্ধ অবস্থানই নাগরিক অধিকার রক্ষা বা বলবৎ করার প্রধান উপায়।