ক. প্রস্তাবনা
১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনা ছিল নিম্নরূপঃ-
আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সংগতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য…।
1.প্রধান দিক
সংক্ষেপে এই সংবিধানে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধে জনগণের বীরত্বপূর্ণ লড়াই, সংবিধানের মূলনীতি বা আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় চরিত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ শাসন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য স্থির, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ অস্বীকার এবং সংবিধানের প্রাধান্য ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বসহ উল্লেখিত হয়।
2. পরিবর্তন
১৯৭৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসন জেনারেল জিয়াউর রহমান এক ঘোষণাবলে সংবিধানের প্রস্তাবনায় কতিপয় পরিবর্তন আনেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় মুক্তির স্থলে জাতীয় স্বাধীনতার, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে Ôসর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় ‘অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের এই কথাগুলো প্রতিস্থাপিত ও সংযোজিত হয়।
খ. প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধান স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই শুধু রচিত হয় নি, এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলোর অন্যতম। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ—
১. লিখিত দলিল : এটি একটি লিখিত এবং অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত দলিল। সর্বমোট ৮৩ পৃষ্ঠায় এতে ১১টি ভাগ, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১টি প্রস্তাবনা ও ৪টি তফসিল রয়েছে।
২. দুষ্পরিবর্তনীয় : এটি একটি দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান। তবে এর পরিবর্তন পদ্ধতি খুব জটিল নয়। জাতীয় সংসদের সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সংশোধনী বিল গৃহীত এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতি দানের মাধ্যমে তা কার্যকর হবে।
৩. এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র : সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মতো কোনো অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশের ব্যবস্থা নেই।
৪. সংসদীয় গণতন্ত্র : সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়। এটি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা নামেও পরিচিত। এতে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভা হচ্ছে প্রকৃত শাসক। রাষ্ট্রপতি থাকেন নামসর্বস্ব। এ ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মন্ত্রিসভার সদস্যগণ যৌথভাবে আইনসভা বা পার্লামেন্টের নিকট দায়ী থাকেন।
৫. এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা : বাংলাদেশে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিধান করা হয়। এর নাম ‘জাতীয় সংসদ’। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ৩০০ জন সদস্য ও এই সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত ১৫ জন মহিলা সদস্য মোট ৩১৫ জন সদস্য নিয়ে শুরুতে এটি গঠিত ছিল। পরবর্তীকালে সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের সংখ্যা ৫০ জনে উন্নীত হলে জাতীয় সংসদের মোট সদস্যসংখ্যা ৩৫০ করা হয়। সদস্যরা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।
৬. মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা : সংবিধানের তৃতীয় ভাগে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কিছু মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
৭. জনগণে সার্বভৌমত্ব : সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ (অনুচ্ছেদ ৭)।
৮. সর্বজনীন ভোটাধিকার : বাংলাদেশ সংবিধানে ১৮ বছর বয়স্ক প্রত্যেক নাগরিককে ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে।
৯. মানবাধিকার সমুন্নত রাখা: সংবিধানের Ôরাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিÕ অংশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
১০. প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির ব্যবস্থা : সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
১১. অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা : বাংলাদেশ সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১৭)।
১২. সংসদ সদস্যদের দলীয় শৃঙ্খলা : কোনো সংসদ সদস্য নিজ দল ত্যাগ করলে বা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তিনি তাঁর সংসদ সদস্যপদ হারাবেন (বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০)। সরকারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ বিধান করা হয়।
১৩. ন্যায়পালের বিধান : বাংলাদেশ সংবিধানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি। সংসদ আইনের দ্বারা এ পদ সৃষ্টি করতে পারবে। ন্যায়পাল যেকোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে তদন্ত পরিচালনা করতে পারবেন। তিনি একমাত্র সংসদের নিকট দায়ী থাকবেন (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৭)।
১৪. সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা : সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধানের আওতায় প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিগণ স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। সংবিধানে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
১৫. প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল : বাংলাদেশ সংবিধানে সাধারণ বিচারব্যবস্থার অতিরিক্ত সংসদ কর্তৃক আইনের দ্বারা এক বা একাধিক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার বিধান করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, বরখাস্ত, পদোন্নতি, দত্ত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাসম্পর্কিত বিষয়াদি এর এখতিয়ারভুক্ত (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৭)।
১৬. জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান : ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো বিধান ছিল না। পরবর্তীকালে তা অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৭. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি : বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার কতিপয় মূলনীতি লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই নীতিগুলো আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য না হলেও এ দ্বারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম অনুপ্রাণিত ও প্রভাবান্বিত হয়।
১৮. সংবিধানের প্রাধান্য : বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা এর পরিপন্থী কোনো আইন কার্যকরী হবে না, বরং তা বাতিল হয়ে যাবে।
গ. পরিবর্তিত রূপ
১৯৭২ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বার বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় এতে ঘটেছে নানা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন । সংবিধানের প্রস্তাবনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, সরকার পদ্ধতি, রাজনৈতিক দল, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এসব পরিবর্তন সংঘটিত হয়। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫-এর ২৪শে জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। এরপর চতুর্থ সংশোধনীর আওতায় রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন ও একটি জাতীয় দল সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর এক জাতীয় দল ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হলেও ১৯৯১ সালের পূর্ব পর্যন্ত সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয় নি। বর্তমানে সংসদীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান।
এ ছাড়া সংবিধানের প্রস্তাবনায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসÕ স্থাপন, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা (অষ্টম সংশোধনী, ১৯৮৮) এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী, ১৯৯৬) ইত্যাদি মূল সংবিধানের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে কতিপয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।