অমর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট কালজয়ী একটি চরিত্র হিমু। আমরা যারা হুমায়ূন আহমেদের লেখা গল্প বা উপন্যাসের সাথে পরিচিত বা বলা যায় যাদের মনের বড় একটা অংশ জুড়ে হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী এসব লেখা জায়গা করে নিয়েছে তারা সবাই আরো অনেক চরিত্রের পাশাপাশি হিমু চরিত্রটির সাথেও খুব ভালোভাবেই পরিচিত। নব্বই দশকের হিমু সিরিজের প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষীর মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ আগমন ঘটান হিমু নামের তুমুল জনপ্রিয় চরিত্রটির। অন্য আর সবার থেকে আলাদা একজন মহাপুরুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাই যার ধ্যান এবং জ্ঞান সেই হিমুর অদ্ভুত কান্ডকারখানা আমাদের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে এখনো।
হলুদ পাঞ্জাবি পরিধান করে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত বা ঝুম বৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তায় খালি পায়ে হেটে বেড়ানো তরুনে মুগ্ধ হননি এমন কোনো পাঠক পাওয়া যাবেনা। মেয়েরা তো বটেই অনেক ছেলেরাও হিমু হতে চেয়েছেন বা এখনো চাচ্ছেন। তবে এই চাওয়া যেনো এক অসাধ্য সাধনের প্রয়াস মাত্র। স্বয়ং হিমুর স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ একবার একটি সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন, ‘হিমু হওয়া বেশ জটিল ব্যাপার’। তারপরে কল্পনার জগত হোক কিংবা বাস্তবতা আলোতে আয়নার সামনে দাড়ানো কোনো যুবক যে হিমু হতে চায়, তা গুনে শেষ করা এককথায় অসম্ভব।
বারবার মেস বদলানো এই ছেলেটার আসল নাম হিমালয় হলেও সবার কাছে হিমু নামেই তার পরিচিতি। তাঁর বাবা মনেপ্রাণে বিশ্বাস , প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মহাপুরুষ তৈরি করা সম্ভব, যাকে জগতের কোন মায়াই স্পর্শ করেনা। আর সেই বিশ্বাস থেকে একজন হিমালয়ের হিমু হয়ে ওঠার গল্প যেনো হুমায়ূন আহমেদ তার লেখনীর মাধ্যমে জীবন্ত এক চরিত্র হিসেবে হাজির করেছেন আমাদের সামনে।
লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, আমাদের সমাজের অনেক অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে হিমুর উপন্যাসগুলোতে। এই শহরে একজন মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার মানেটাও যেনো লেখক দেখিয়ে দিয়েছেন। হিমুর উদ্ভট কর্মকান্ড আমাদের আনন্দ দেয় কারন আমাদের মনের গভীরে আমার সবাই আসলে এমন স্বাধীনতাটাই চেয়ে আসছি। আমাদের মনের অজান্তেই আমরা অনেকবার নিয়মকানুনের বেড়াজাল ভেঙে দিতে চেয়েছি। কিন্তু আমরা পারি নাই যেটা খুব সহজেই হিমু পারে। তাই সে যখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে খালিপায়ে নিজের কমফোর্টেবল হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে পথে পথে হেটে বেড়ায় তখন আমরা এই পাগলাটে অদ্ভুত ছেলেটার মাঝে যেনো নিজেদেরকে দেখতে পাই বার বার।
মাজেদা খালা বা বড় ফুপু, বড় ফুপা এই চরিত্র গুলো যেমন হিমুকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসে ডালপালা মেলেছে তেমনি একটি কালজয়ী চরিত্র হিসেবে পাঠকের সামনে ধরা দিয়েছে রূপা। লেখক নিজেই তার লেখা এই বইয়ে লিখে গেছেন যে, একটা সময় হিমুর জীবনে আসে জগতের সবচেয়ে মায়াবতী আর ‘রূপবতী’ এক মেয়ে। হিমু তাকে ডাকে রূপা বলে। একসময় এই মেয়েটা ভালোবেসে ফেলে অগোছালো হিমুকে। হিমুর অসাধারণ কিছু বিষয় রূপাকে টানতে থাকে প্রবল ভাবে। এখানে আমরা হিমুর দুইটা সত্তা দেখতে পাই যে, হিমু রূপার কাছে নিজেকে ধরা দেয় না ঠিক, তেমনই আবার চলেও যায় না সে। কারন তার বাবার স্বপ্ন মোতাবেক হিমুকে হতেই হবে একজন মহাপুরুষ। প্রেম ভালবাসা উপেক্ষা করা তাই তাঁর ধর্মের মধ্যে পড়ে। মায়াজালে আটকা পড়তে গেলেই সে খুব সহজ ভাবেই উধাও হয়ে যায়। একটা সময় হিমু যে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে সেটাও স্বাভাবিক হয়ে যায় রূপার কাছে। সে মেনেই নেয় যে, হিমুকে তার পাওয়া হবেনা যেভাবে আর দশটা মানুষ তাদের ভালোবাসার মানুষকে জীবনে পেয়ে যায়। তবুও হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানো ছেলেটার প্রেমে অবিরাম হাবুডুবু খেতে থাকে রূপা। অন্যদিকে সব বুঝেও হিমু কিন্তু নিরুপায়। কারন তার মতে, ভালোবাসার মানুষদের খুব কাছে কখনও যেতে নেই। হিমুরা কখনো প্রাণ খুলে ভালবাসতে জানে না, হাত ধরতে জানেনা। এটাই ধ্রুব সত্য মেনে হিমুর পথচলা।
ভালোবাসার এই সমীকরণটা সরিয়ে যদি খুব সুক্ষ্ম ভাবে চিন্তা করি তাহলে হুমায়ূন আহমেদ যে তার লেখার মধ্য দিয়ে একটি ভিন্ন বিষয় আমাদের উপলব্ধির জায়গায় ভাবনার খোরক হিসেবে যুক্ত করেছেন সেটা নজরে পড়বে। আমাদের ক্ষুদ্র জীবন এবং আমাদের জীবনের লক্ষ্যকে আমরা নিজ নিজ নিজ জায়গা থেকে যতোটা বিশাল বা মহান বলে মনে করি না ক্যানো আসলে সেটা নাই এর বরাবরইম কারন সৃষ্টিকর্তার এই বিশাল সৃষ্টিতে আমরা এক ধূলিকণার সমানও না। আমাদের অনুপস্থিতি এই মহাবিশ্বে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করবেনা বা করেও নি।
তাহলে শুধু শুধু কেনো এই ব্যস্ততা, কেনোই না এতো কর্মযজ্ঞ? আমাদের রোজকার জীবনের আয়নায় ঠিক এই জায়গাতেই অদ্ভুত চরিত্র হিমুর আবির্ভাব। হিমু’র মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই ছোটাছুটি, শীর্ষ স্থান দখলের যুদ্ধের বাইরেও একটা জগৎ আছে। সেটার সৌন্দর্য উপভোগ করাও মানব ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খালি পায়ে হেটে মাটির স্পর্শ নেয়া, চাঁদ- সূর্য এর আলাদা সৌন্দর্য্য উপভোগ করা, জোছনা আলো হোক বা বর্ষার পানি অথবা কৃষ্ণচূড়ার রঙে নিজেকে নতুন ভাবে চেনা সবই আমাদের উপভোগ করতে হবে। সবকিছুর অর্থ থাকবে এমনটা তো না। বরং অর্থহীন হওয়াতেই জীবনের সার্থকতা। কারন জন্মের আগে থেকেই আমাদের জীবনের বেশিরভাগ ভাগ্য আগে নির্ধারিত হয়েই আছে। আমাদের চেষ্টায় সেটার খুব বেশি পার্থ্যক্য আসবেনা। আদতে আসেও না কিন্তু!!!
হুমায়ূন আহমেদের লেখার জাদুতে হিমুকে নিয়ে ২১ টি উপন্যাস গ্রোগাসে উপভোগ করেছি আমরা। প্রথম উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’ থেকে পাঠকদের একটা ঘোর শুরু হয় সেই অদ্ভুত ঘোরটা শেষ উপন্যাস ‘হিমু এবং হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই’ পড়ার পরেও শেষ হয় না। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে যে, হিমুর প্রতিটি উপন্যাস পড়ার পরে কোথাও না কোথাও আমাদের মনে হবে যে, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের খুব হালকা ভাবে ভাল কাজ করার আনন্দ কেমন হয় সেটা জানান দিচ্ছেন। একজন মানুষ যে আসলে আরেকজন মানুষের জন্য এই কথাটাও তিনি বহুবার হিমু চরিত্রের মধ্যে দিয়ে আমাদের মন এবং মগজে প্রবেশ করাতে চেয়েছেন।
হুমায়ূন সফল কিনা তা বলার বা লেখার যোগ্যতা আমার নেই। তবে তার এই অমর চরিত্র হিমু অনেক বেশি রহস্যময় একই সাথে কখনো অচেনা আবার কখনো খুবই বাস্তবঘেষা।কে জানে আমাদের এই খুব চেনা শহরেই কোনো চেনা রাস্তাতেই একজন অচেনা হিমু হেঁটে যাচ্ছেন প্রতিদিন। আমরা দেখি কিন্তু চিনতে পারিনা!!!