বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সংগীত উন্মাদনার নাম বিটিএস। দক্ষিণ কোরিয়ান ছেলে ব্যান্ড বিটিএস এর আরেক নাম ব্যাংকটন বয়েজ। আধুনিক বিনোদনের ক্ষেত্রে, খুব কম নামই বিটিএসের মতো রোমাঞ্চকর এবং উন্মাদনার শীর্ষে । এই ব্যান্ডটি দক্ষিণ কোরিয়ার সীমানা, ভাষা এবং ঘরানার ঊর্ধ্বে গিয়ে গোটা বিশ্বে একটা বহুল আলোচিত নামে পরিচিতি লাভ করেছে। তাদের সঙ্গীত, বার্তা এবং উপস্থাপন সিউল থেকে সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এক উচ্ছ্বাস জাগিয়ে তুলেছে, যা সারা বিশ্বের হৃদয় ও মনকে মুগ্ধ করেছে। তবুও, বিটিএসের যাত্রাটি তিক্ততার বিতর্কের অংশ ছাড়া হয়নি।
আকর্ষণীয় পোশাক মন মাতানো নাচ আর চকচকে ভিডিওতে ইতিমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ নয় চাকচিক্য তারকা জীবনের পাশাপাশি ভক্তদের সামনে তারা তাদের কঠিন পরিশ্রমের গল্পগুলো ভাগ করেছে। এছাড়া ভক্তদের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে রাখতে হয় মিউজিক কে কীভাবে গ্রহণ করতে হয় তা তাদের ভালোই জানা, যে কারণে বিটিএস আর তাদের ভক্তদের একটা গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভক্তরা মনে করেন বিটিএস এর গানগুলো যেকোনো ধরনের প্লেলিস্টের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। বি্টিএস সহকর্মীদের থেকে তাদের শিল্পচর্চার ধরন ভিন্ন। সমাজে যে প্রচলিত ধারণাগুলো আছে তার বিপরীতে অবস্থান নেয় বিটিএস। এসব চিন্তা ভাবনা উঠে আসে তাদের কথায় কাজে, গানে ও সুরে, কেপপ মিউজিক জগতে আসার আগেই ধারণা ছিল একদমই বিরল।
২০১৩ সালের বিগ হিট এন্টারটেইনমেন্টের অধীনে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আরএম, জিন, সুগা, জে-হোপ, জিমিন, ভি এবং জংকুক সদস্যদের নিয়ে গঠিত এই দলটি নিজেদের লেখা গান, নিজস্ব সুর এবং নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে দর্শকের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য, সমস্য, বয়ঃসন্ধিকাল এবং নিজেদের ভালোবাসার দিক নিয়ে বিটিএস ব্যান্ডের গান গুলো তরুণ প্রজন্মের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। বিটিএস দলটি মূলত হি পপ সঙ্গীতের গ্রুপ হলেও তাদের গানগুলোতে বিভিন্ন সংগীতের ধরন প্রকাশ পায়। সাত সদস্যের কে-পপ গ্রুপটি একটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি করেছে খুব অল্প সময়ে।
বিটিএস কেবল সংগীতের মধ্যেই থেমে থাকেনি; তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, বন্ধুত্ব এবং প্রচেষ্টা দ্রুত তাদের একটি বিশ্বব্যাপী ফ্যানবেস অর্জন করেছিল, যা “আর্মি” নামে পরিচিত। বিটিএস এবং আর্মি একসাথে এমন একটি সংযোগ তৈরি করেছে যা সাধারণ গতিশীলতাকে অতিক্রম করে, পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বিটিএসের প্রথম কোরিয়ান ভাষার স্টুডিও অ্যালবাম ডার্ক এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৪ সালে। আর এই অ্যালবামটি ১ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল কোরিয়ায়। ২০১৭ সালে পুরো বিশ্বের সংগীতজগতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নেয় এই ব্যান্ড দল। ২০১৮ সালের লাভ ইয়োরসেলফ টিয়ার অ্যালবামটি বিলবোর্ড ২০০ চারটে প্রথম অবস্থানে ছিল। এছাড়াও বিটিএসের দখলে রয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড এর কয়েকটি রেকর্ডি। দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া অ্যালবাম। বিটিএসের দখলে ৬টি আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, ৯টি বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, চব্বিশটি গোল্ডেন ডিসকভার অর্জন করেছে এই তরুণ ব্যান্ডটি।
বিটিএস ভক্তরা শুধু যে তাদেরকে প্রথম অবস্থানে নিয়ে গেছে তা নয় বরং তাদের ইতিবাচক বার্তা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে। আর দশটা ব্যান্ডের মত কাজ না করে সমাজের ওই সমস্ত জিনিস গুলো তুলে ধরেছে যেগুলো নিয়ে কেউ কথা বলছে না। যেমন মেন্টাল হেলথ, বুলিং সে্লফ-লাভ আর এর সমস্ত কারণেই মূলত তরুণ সমাজের খুবই সাড়া পেয়েছে দলটি। বিটিএস বলা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে তরুণদের সক্রিয়তার প্রতীক। শুধু সাফল্য শেষ কথা নয় আছে সমালোচনা ও পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসারী হওয়ায় তাদের গানে যে সংস্কৃতি দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় সেটি বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেও কারো কারো অভিমত। কারণ সাধারণত বাঙালিরা হুজুগে বিশ্বাসী বলে একটা কথা রয়েছে। বিটিএস জনপ্রিয় হলেও অধিকাংশ মানুষ কিন্তু তাদের ভাষা বুঝতে কিছুটা হলেও অক্ষম। বুঝে হোক না বুঝে হোক ঝোঁক একটা রয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। নাচ-গান সব ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালির সংস্কৃতি স্টাইল নষ্ট হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। বিটিএস এর গানগুলোর কথা যেহেতু মানুষকে বার্তা দিচ্ছে সেটা বুঝুক বা না বুঝুক বাকি স্টাইল ফলো করতে ব্যস্ত একদল তরুণ। তরুণ প্রজন্ম যখন তাদের অনুসরণ করছে তখন থেকেই পোশাক-আশাকে তাদের নীতিমালা মেনে চলছে। যে বিষয়গুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয় বলে মনে করেন অনেকে। বিটিএস তাদের সংস্কৃতি অনুসরণ করে তাদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে তাই দেশের তরুণ প্রজন্মকে ও নিজেদের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিকে ধরে রাখা উচিত বলে মনে করেন বোদ্ধারা অন্যথায় হারিয়ে ফেলতে হবে বাঙালির গান সুর ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বিশ্বায়নের যুগে, বিটিএস একটি সাংস্কৃতিক সেতু হিসাবে কাজ করে, যা বিশ্বব্যাপী কোরিয়ান সংস্কৃতির সচেতনতা এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রচার করে।
দলটি ইউনিসেফের সাথে #ENDviolence প্রচারাভিযান এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে তাদের সাম্প্রতিক $১ মিলিয়ন ডলার অনুদান সহ সমালোচনামূলক সামাজিক বিষয়গুলি মোকাবেলায় ধারাবাহিকভাবে তাদের প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করেছে। বিটিএস শিল্পীদের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য তাদের প্রভাবকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনাকে মূর্ত করে তোলে।
বিটিএস-এর অপরিসীম জনপ্রিয়তা এবং কে-পপের পণ্যকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকে। কিছু সমালোচক যুক্তি দেন যে এই দলের সাফল্য এশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে পশ্চিমা স্টেরিওটাইপগুলিকে স্থায়ী করেছে, অন্যরা মূলত পশ্চিমা-অধ্যুষিত সঙ্গীত শিল্পে বাধা ভাঙার জন্য।
সঙ্গীত ইতিহাসে, বিটিএস-এর গল্পটি বিজয়ের। তাদের প্রভাব মঞ্চের বাইরেও বিস্তৃত। লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছেছে তাদের সঙ্গীত বার্তা, সান্ত্বনা, অনুপ্রেরণা এবং ঐক্য। বিটিএসকে ঘিরে থাকা উন্মাদনার মধ্যে আমরা কেবল সংগীতই নয়, একটি আন্দোলন, আশার আলো এবং শক্তির প্রমাণ খুঁজে পাই।