বাংলাদেশ সম্প্রতি এক গণবিপ্লব সম্পন্ন করেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে নিপীড়ন চালানো আওয়ামীশাহীর পতন ঘটিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। গোটা দেশ এখন নতুন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। পরাজিত গণবিরোধী শক্তি যেমন মাথাচাড়া দিচ্ছে, তেমনি এমন কিছু বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে যা আশঙ্কাজনক।
এর একটা হচ্ছে আদালত চত্বরে আসামিদের ওপর হামলা। আদালত হচ্ছে একটা দেশের মানুষের আস্থার জায়গা, যেকোনো অনাচারের বিরুদ্ধে আশ্রয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম পাপ ছিল এই আস্থার জায়গাকে ভেঙ্গে দেওয়া।
ফলত, সেই পঙ্কিলতা থেকে উঠে আসার জন্য দেশকে ঠিকঠাক করতে করণীয় কাজ হচ্ছে সুবিচার নিশ্চিত করা। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতাকে ঊর্ধ্বে রাখতে না পারলে সেই কাজ সম্পন্ন করা যাবে না। কিন্তু, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সম্প্রতি আদালতে হাজির করা আসামিদের ওপর শারীরিক আক্রমণ করা হচ্ছে।
আওয়ামী আমলের এক বিচারককে বাজেভাবে হামলা করা হয়েছে। বিচারের বদলে প্রতিশোধপরায়ণতা দেখালে আসলে জাহেলিয়াতের নীতিরই আবার পুনরাবৃত্তি হবে।
একই ব্যাপার দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীরা গিয়ে দলবেঁধে বিভিন্ন শিক্ষককে অপসারণ করছেন, নিগৃহীত করছেন। কোনো সন্দেহ নাই, অনেক শিক্ষক আওয়ামী দালালি করেছেন, কিন্তু তা যাতে আর ফিরে না আসে এর জন্য আমাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে, মব জাস্টিস নয়।
একই ব্যাপার দেখা যাচ্ছে মামলা দেওয়ার ব্যাপারেও। ক্রিকেটার এবং আওয়ামী এমপি সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়া হলো। সাকিবের আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহু সময় আওয়াজ উঠেছে এবং সেগুলো বিচার হওয়া জরুরি। সাকিব খুনের সাথে জড়িত হতে পারেন, এই ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, আর্থিক মামলাগুলো হওয়ার আগে হুকুমের আসামি হিসেবে খুনের মামলা দেওয়াটা অতি উৎসাহী ঠেকে। আমরা অতীতে দেখেছি, এই ধরনের অতি উৎসাহ মামলাগুলোকে খেলো করে দেয়। দোষীদের এক ধরনের দায়মুক্ত করে দেয়া হয়।
এই সময় চলছে প্রলয়ংকরী বন্যা। এর মধ্যেও আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠ গরম করা হচ্ছে। সচিবালয় ঘেরাও ও ভীতি প্রদর্শন হচ্ছে। এগুলা ভালো লক্ষণ নয়। যেকোনো মূল্যে এগুলো ঠেকাতে হবে। বিপ্লবকে বেহাত হতে দেওয়া যাবে না।
এই অবস্থায়, প্রথম কাজ হচ্ছে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ফেরানো, এরপর ধসিয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরামত করা। আর দ্রুততম সময়ে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। কেননা, জনপ্রতিনিধিরাই গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারে। জনগণের ভোটাধিকার গণতন্ত্রের ভিত্তি।
ফলত, এখন যেসব কাজ না হলেই না, বিশেষত তাত্ত্বিক বিতর্কের সুযোগ যেখানে আছে, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। যেই দারুণ ঐক্যর মধ্যে দিয়ে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছিল সেই ঐক্য যদ্দুর সম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করা উচিত। মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি ক্রান্তিকাল। শুধু তাই না, এই সরকারের সমস্ত কিছু পরিবর্তন করার এখতিয়ারও নেই।
অথচ, এই সময় রব উঠলো জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের। এমন না যে, জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয়, কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংগীতের আশু পরিবর্তন করতেই হবে তা না। এই সংগীত হাসিনার আমলে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নির্বাচিত এই সংগীত দেশের জন্মলগ্ন থেকেই ছিলো। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হাতিয়ার বানিয়েছিল বলে মুক্তিযুদ্ধকে কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। এতো কিছুর পরেও, দেশের অধিকাংশ জনতা যদি মনে করে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা দরকার, তার জন্য গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরকম একটা সিদ্ধান্তে যাবার এখতিয়ার যেমন সীমিত তেমনি এই ক্রান্তিলগ্নে সময়েরও অপচয়।
এরচেয়ে অনেক জরুরি হচ্ছে ডিএসই আইন বাতিল করা। যেই আইন জনতার অধিকার কেড়ে নিয়েছিলো। সকল খুনি ও দুর্নীতিবাজদের বিচার করা আর অতি অবশ্যই আন্দোলনে শহীদদের তালিকা করা এবং আহতদের পাশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দাঁড়ানো।
গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ যে কোনো দাবি করতেই পারে। তবে বৃহত্তর স্বার্থে, সময়ের প্রয়োজনে কিছু কিছু অসময়োচিত দাবি উপেক্ষা করাও জরুরি।
ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখতে পাই বহু বিপ্লব, যেগুলি তাদের মহৎ উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও, বিজয়ের পর ভেঙে পড়েছিল। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব “স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব” এর প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি রক্তপাত আর আতঙ্কের রাজত্বে পরিণত হয়েছিল। ১৯১৭ সালের রাশিয়ান বিপ্লবও সমতা আর ন্যায়বিচারের স্বপ্ন নিয়ে শুরু হলেও, এর পরিণতি ছিল অত্যাচারী শাসনের অধীনে কোটি মানুষের ভোগান্তি।