বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪
28 C
Dhaka

বে-নজির পরিকল্পনার ছোট বাজেট

আরো পড়ুন

- Advertisement -

যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই নজিরবিহন প্রত্যাশার ছোট বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করার চারটি অগ্রাধিকার ঠিক করে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার নতুন বাজেট বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এ বাজেট আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বড়। আগের বছরগুলোতে বাজেটের আকার ১০ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বড় করা হলেও সে তুলনায় এবার অনেকটাই আঁটোসাঁটো বা ছোট হয়েছে বাজেট। তবে, আয় বাড়াতে এক বছর পর বাজেটে আবারও ফেরত আনা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ। নতুন বাজেটে বড় আশার কথাও শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দেশে কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি থাকলেও সেই মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় এত নিচে নামবে মূল্যস্ফীতি সেই ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা বাজেটে নেই।

যে চারটি অগ্রাধিকার ঠিক করে বাজেট দেয়া হয়েছে এরমধ্যে রয়েছে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করা, বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের পরিবেশ উন্নত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সেই পরিকল্পনা বাজেটে নেই। অথচ অর্থমন্ত্রী এই বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’। ১৭৪ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ার ইচ্ছামাফিক প্রতিশ্রুতি থাকলেও সংকট সামাল দেয়ার উপায় বলা নেই। সংকট বিবেচনায় অর্থমন্ত্রী এবার আয় বুঝে খরচ করার পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু বাজেটের তথ্য বলছে, সরকার যে আয় করবেন তার চেয়ে ব্যয়ের খাত এবারও বড়। এ বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে ধার করতেই হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির অনুপাতে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস হতে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ধার করার পরিকল্পনা সরকারের। এরপরও খরচ সংকুলান না হওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে মোট এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। বাকি অর্থের মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি এবং অন্য খাত থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ধার করতে চান অর্থমন্ত্রী। এদিক বিবেচনায় এবারের বাজেট অনেকটাই ব্যাংক ঋণ নির্ভর। অন্যদিকে, বড় রাজস্ব ঘাটতি থাকার পরও এবার ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের নতুন লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। এরমধ্যে রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর নিয়ন্ত্রিত করের পরিমাণ ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের টার্গেট এনবিআরের ওপর চাপিয়ে দেয়া বাস্তবসম্মত হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এজন্য সবার আগে দরকার ছিল রাজস্ব কাঠামোয় সংস্কারের ঘোষণা। কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি নতুন অর্থমন্ত্রী।

বাজেটে খরচের লাগাম টানার বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসা দাবি রাখে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। চলতি বাজেট আগের মূল বাজেটের চেয়ে মাত্র ৩৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা বেশি। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় বাজেট বড় হয়েছিল ৮৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এবার বাজেট ছোট হলেও খরচের খাতও তুলনামূলক কম। নতুন মেগাপ্রকল্পের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এবার পুরনো প্রকল্প দ্রুত শেষ করার দিকে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সে কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি এবার বড় করেছেন মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা। সবমিলিয়ে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দিয়েছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের আরেকটা ভাল দিক প্রবীণ বা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো। যদিও এখনকার অর্থনীতি এবং দরিদ্র মানুষের আয় বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষার এই বরাদ্দ মোটেও সন্তোষজনক বলা যাবে না।  কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে এখন সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের মানষ। কিন্তু সে বিবেচনাও আমলে নেননি অর্থমন্ত্রী। মধ্যবিত্তের জন্যও বাজেটে কোনো সুখবর নেই। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমাও নড়চড় করেননি তিনি। ব্যক্তি পর্যায়ের করমুক্ত আয়সীমা তিনি সীমাবদ্ধ রেখেছেন আগের সাড়ে তিন লাখ টাকাতেই। এ সিদ্ধান্ত ভালো চোখে দেখছেন না অনেকে।

মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারেও বাজেটে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই। উচ্চ বাজারদরের কারণে গলাপর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য তেমন সুখবর নেই। বাজেট ঘাটতি কমানো এবং কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্য সরকার ঠিক করেছে তা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। যদি বা অনুমান নির্ভর এসব পরিকল্পনার সুফল আদৌ আসবে কি-না তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। কিছু নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক বা কর কমানোর সিদ্ধান্ত বাজেটে দেয়া হলেও অন্য অনেক ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হয়েছে। যা ঘুরেফিরে চাপ বাড়াবে ভোক্তার ওপর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর পরামর্শ মেনে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার ফলে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ আরও বাড়বে। কারণ রাজস্ব বাড়াতে নতুন কোনো সংস্কারের পদক্ষেপ নেননি অর্থমন্ত্রী। তাই নিয়মিত যারা কর দেন তাদের উপরই বাড়বে করের বোঝা। কারণ আয়করে কোনো ছাড় দেননি অর্থমন্ত্রী। উল্টো ভ্যাটের বোঝা বাড়িয়েছেন। এতে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।

এবারের বাজেটে সবচেয়ে নজিরবিহিন সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দিয়ে। নানা সমালোচনার কারণে গতবছর নির্বাচনী বাজেটে কালো টাকা বৈধতার সুযোগ তুলে নিয়েছিলেন আগের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু এবার পুরোনো পথেই হাঁটলেন প্রথমবার বাজেট দেয়া অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে প্লট, ফ্ল্যাট বা জমি কেনায় অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ অবারিত করেছেন তিনি। শুধু ব্যক্তি নয়, কোম্পানির অপ্রদর্শিত সম্পদও নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে বৈধতার সুযোগ ফেরত এনেছেন তিনি। দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করতে এই সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। কোনো যুক্তিতেই এ সুযোগ দেয়া গ্রহণযোগ্য নয়, এমন বিশ্লেষণ তার। কারণ হিসেবে বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত সংবিধানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। দুর্নীতিবাজদের তিরস্কারের বদলে পুরস্কৃত করার উদাহরণ নজিরবিহিন।

সৎ করদাতারা যেখানে ৩০ শতাংশ কর দেন, সেখানে দুর্নীতিবাজরা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে পার পাবেন সেটা কখনো যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। এ কারণে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার মতো এমন প্রস্তাবকে ‘বে-নজির’ বাজেট বা অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সরাসরি না বললেও এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো ‘সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ’ এর নজিরবিহিন দুর্নীতির কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। টানা চারবার ক্ষমতায় থাকা এ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সাথেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া সমীচিন হয়নি বলে মনে করেন তিনি। কারণ হিসেবে বলেছেন, নতুন বাজেটে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতাদের বার্ষিক আয়ে ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩০ শতাংশ করহার নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের কর দিতে হবে মাত্র ১৫ শতাংশ। সেই হিসাবে সৎভাবে যারা ব্যবসা করবেন বা আয় করবেন তাদের তুলনায় দুর্নীতিবাজদের কর দিতে হবে অর্ধেক হারে। কর ব্যবস্থাপনায় এটা সম্পূর্ণ বে-নজির। এর মধ্য দিয়ে সৎ করদাতাদের নিপীড়ন করে প্রকৃতঅর্থে কর দিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।    

আলোচিত

কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Click to Call Call Now

সর্বশেষ