শুক্রবার, জানুয়ারি ২৪, ২০২৫
19 C
Dhaka

আত্মজীবনী: ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ

spot_img

ভিডিও

- Advertisement -

রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও লেখক তিন পরিচয়েই সমুজ্জ্বল ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, উদার গণতান্ত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, । বারবার দল বদলের অপবাদ থাকলেও, নিজের রাজনৈতিক দর্শন থেকে সরে যান নি কখনো। আজীবন দেশ ও মানুষের সেবা করে গেছেন।

৫০ বছরের ইতিহাসে তিন পেশার সরব ভূমিকা তাকে কখোনো নন্দিত, কখনো করেছে নিন্দিত। দেশে  তার এই মিশ্র ভাবমূর্তি থাকলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। অস্ট্রেলীয়-ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক জন পিলজার নোয়াম চমস্কি তার কাজকে বলেছেন ‘অন্ধকারে আলোক সংকেত’।

স্বাধীনতা সংগ্রামেও সক্রিয় ছিলেন মওদুদ আহমদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজনদের একজন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী। সে সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করতে খ্যাতিমান বৃটিশ আইনজীবী টমাস উইলিয়াম কিউসিকে নিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন মওদুদ আহমদ। পরে মুজিবনগর সরকারে প্রভাবশালী কর্মকর্তা পোস্টমাস্টার জেনারেল হয়েছেন। তিনি জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে ক্ষমতার মসনদে ছিলেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের জীবনী এক নজরে

নাম                          : ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ
জন্ম                         : ১৪ মে ১৯৪০

বয়স                        : ৮০বছর
জন্মস্থান                    : 
মানিকপুর গ্রাম, কোম্পানীগঞ্জনোয়াখালী,
পেশা                        : আইনজীবি, রাজনীতিবিদ , লেখক
রাজনৈতিক দল           : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল 

                                    (১৯৭৮–১৯৮৪), (১৯৯৬–২০২১)

                                    জাতীয় পার্টি (১৯৮৪–১৯৯৬)


নাগরিকত্ব                 : ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)

                               পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)

                               বাংলাদেশ (১৯৭১২০২১)
দাম্পত্য সঙ্গী             : হাসনা জসিম উদ্দিন মওদুদ

সন্তান                      : ২ ছেলে ও ১ মেয়ে

শিক্ষা                       : ঢাকা কলেজ,

                               ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,

ধর্ম                          : ইসলাম 

মৃত্যু                         : ১৬ মার্চ ২০২১

সমাধিস্থল                  : পারিবারিক কবরস্থান

                                মানিকপুর গ্রাম, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী

গ্রন্থাবলি                    : ডেমোক্রেসী অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট, এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারী ইন্টারভেনশন ইন  বাংলাদেশ, এরা অফ শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ১৯৯১ থেকে ২০০৬, কারাগারে যেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮ বাংলাদেশ: শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy (1976), Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman (1983), Democracy and the Challenge of Development – A Study of Politics and Military Interventions in Bangladesh (1995), South Asia Crisis of Development: The Case of Bangladesh (2002), Bangladesh: A Study of the Democratic Regimes (2012), Bangladesh: Emergency and the Aftermath 2007-2008 (2014)

জন্ম ও শিক্ষা

১৯৪০ সালের ২৪ মে, ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তার পিতা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও মাতা বেগম আম্বিয়া খাতুনের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে মওদুদ আহমদ চতুর্থ।

মওদুদ আহমেদ প্রথমে ঢাকা কলেজে পরে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাশ করে ব্রিটেনের লিঙ্কনস ইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যারিস্টার অ্যাট ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন

বার-অ্যাট-ল শেষ করে ৬০ এর দশকের মাঝামাঝি লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পরই হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি তখন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের জুনিয়র হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৩), জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৬, ১৯৮০, ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১০), ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের (১৯৮১, ১৯৯৮, ২০১১ ও ২০১২) ফেলো ছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক অধ্যায়

স্কুল ছাত্র থাকার সময়েই ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে জেল খেটেছিলেন মওদুদ আহমদ। ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ছিলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরমান উল্লাহ খানের প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির সাথে জড়িত হন। ৬০ এর দশকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার সমর্থনে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামেন। একজন আইনজীবী এবং অরাজনৈতিক, অবৈতনিক সচিব হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে থেকেছেন। আইয়ুব খানের সাথে দুই দফা গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সহকারী হিসেবে  ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ  শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি শাসকদের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের পোস্টমাস্টার জেনারেল ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকদেরও অন্যতম একজন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে লন্ডনে অবস্থান করে তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে জনমত সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ নামে একটি ইংরেজি মুখপত্র নিয়মিত প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করেন। তখন মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত ডাকটিকিট প্রকাশ ও শুভেচ্ছামূল্য বাবদ অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন তিনি।

জনপ্রতিনিধি

বিএনপি প্রতিষ্ঠার আগে জাগদল গঠন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। মওদুদ ছিলেন সেই জাগদলের ১৯ সদস্যের আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য। তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে ডাক, টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব (৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৭ – ২৯ জুন ১৯৭৮) পালন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠার সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  নোয়াখালী-৫ আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৫ এপ্রিল ১৯৭৯ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা ছিলেন। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসনামলে গুলশানের বাড়িসংক্রান্ত মামলায় মওদুদের বাড়ি বাজেয়াপ্ত হয়। তিনি ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।

উপপ্রধানমন্ত্রী

জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে বাংলাদেশের উপ প্রধানমন্ত্রী (১৫ এপ্রিল, ১৯৭৯ – ২ জানুয়ারি, ১৯৮০) হিসেবে বিদ্যুৎ, পানি সম্পদ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পুনরায় উপ প্রধানমন্ত্রী  (৯ জুলাই, ১৯৮৬ – ২৭ মার্চ ১৯৮৮) হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

মন্ত্রী

১৯৮০ সালে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্টারকালেক্টর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান তাকে মন্ত্রীসভা থেকে অব্যাহতি দেন। ১৯৮৫ সালে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৮৫ সালেই তিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। জাতীয় পার্টি গঠনে তখন মওদুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মন্ত্রীসভায়  তিনি বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী (৫ আগস্ট, ১৯৮৫ – ২৩ মার্চ, ১৯৮৬) ছিলেন।

জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির হয়ে তিনি তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলন করেন। ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নোয়াখালী-৫ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে পরাজিত হন।

১৯৯৬ সালে বিএনপি বিরোধী দলে গেলে তিনি পুনরায় বিএনপিতে যোগ দিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  নোয়াখালী ৫ আসন থেকে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন।  অষ্টম জাতীয় সংসদের মন্ত্রীসভায় তিনি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (১০ অক্টোবর, ২০০১ – ২৯ অক্টোবর, ২০০৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নোয়াখালী ৫ আসন থেকে পরাজিত হলেও খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া বগুড়া ৭ থেকে ২০০৯ সালের উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নোয়াখালী ৫ আসন থেকে পরাজিত হন।

ব্যক্তিগত জীবন

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের স্ত্রী পল্লিকবি জসিমউদদীনের মেয়ে হাসনা জসীমউদদীন মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং এরশাদ সরকারের সময়ে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। এই দম্পতির দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। বড় ছেলে আসিফ মওদুদ ছোট বয়সেই মারা যান। তার দ্বিতীয় সন্তান আমান মওদুদ প্রতিবন্ধী ছিলেন এবং তিনিও ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মারা যান। তার একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার আনা আসপিয়া মওদুদ স্বামীসহ নরওয়েতে থাকেন।

মৃত্যু

সিওপিডি রোগে আক্রান্ত হলে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি  সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয় তাকে। পরে ১৬ই মার্চ সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিট নাগাদ মৃত্যুবরণ করেন মওদুদ আহমেদ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তাকে সমাহিত করা হয় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মানিকপুর গ্রামে বাবা-মায়ের কবরের পাশে।

- Advertisement -
spot_img

আলোচিত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ

ভিডিও