শুক্রবার, জানুয়ারি ২৪, ২০২৫
22 C
Dhaka

ভয়াল ২৫ মার্চঃ ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা

spot_img

ভিডিও

- Advertisement -

একাত্তরের মার্চের ২৫ তারিখে বাংলার বুকে নেমে আসে অত্যাচার, উৎপীড়ন, পাশবিকতা, নৃশংসতা আর হিংস্রতার কালরাত্রি। পাক হানাদার বাহিনী ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে এই দিনেই। বাঙালি যখন তার অধিকারকে আঁকড়ে ধরেছিল, বর্বর পাকিস্তানি শাসকরা তখনই বুঝতে পেরেছিল কোনো কিছু দিয়েই এই জাতিকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তাই একাত্তরের সেই রাতে শুরু করে জঘন্যতম গণহত্যা। যা জন্ম দেয় মুক্তিযুদ্ধের। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম।

 

মার্চের শুরু থেকেই আন্দোলন-সংগ্রাম আর বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘাতের ঘটনা ঘটলেও ২৫শে মার্চ সকালেও পাকিস্তানি নেতাদের কর্মকাণ্ডে ভয়ংকর নির্মমতার বিন্দুমাত্র আভাসও ছিল না। ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক হয়। সেদিন সকালে সংবাদপত্র থেকে মানুষ জানতে পারে, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ নেতা আগের দিন তাড়াহুড়ো ঢাকা ত্যাগ করেছেন। দুপুর থেকেই নানা গুঞ্জন ছিল। এর মধ্যে রয়েছে, সামরিক আইন প্রত্যাহার করে কেন্দ্রে আপাতত ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার গঠন করা হবে, প্রদেশগুলোয় নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে।এছাড়া পার্লামেন্টের বাইরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যরা আলাদাভাবে মিলিত হয়ে ৬ দফার প্রেক্ষাপটে সংবিধানের জন্য সুপারিশ করবেন।(১)  কিন্তু ইয়াহিয়া খানের প্রস্থানের পরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। খবর শুনে রাত নয়টার পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করবে, এই অনুমানে ছাত্র-জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করে। খবর পেয়ে রাত নয়টার পর আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া সামরিক সমাধানের পথ খুঁজছেন। এর মাধ্যমে তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন। রাত ১০টায় তিনি কিছু নির্দেশ জারি করে জনতাকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।(২)

 

একাত্তরের ২৫শে মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাত পৌনে আটটায় গোপনে বিমান যোগে ঢাকা ত্যাগ করার আগেই নির্দেশ দিয়ে যান নিরপরাধ বাঙালিদের ওপর কাপুরোষোচিত সশস্ত্র হামলা চালানোর। রাত ১ টা বাজার সাথে সাথে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২ তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা জল্লাদের মতো মেশিনগান, মর্টার  আর ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরপরাধ জনগনের ওপর। শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট সহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র, শিক্ষকসহ হত্যা করে প্রায় ৫০ হাজার সাধারণ মানুষকে। একই সাথে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় দেশের অন্যান্য শহরেও। সামরিক ভাষায় এই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। আকস্মিক আক্রমন হলেও আক্রমন যে হতে পারে সেটি আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল বাঙালি জাতি। তবে রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে তা ছিল কল্পনার বাইরে।

 

সেই রাতে ব্যাপক নিধনযজ্ঞের প্রস্তুতি নিয়ে তারা বেরিয়ে আসে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে। ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনারা প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় ঢাকার ফার্মগেটের কাছে। প্রতিরোধকারীদের তারা হত্যা করে। সেনাবাহিনী লাউড স্পিকারে গোটা ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারির ঘোষণা দিয়ে ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে। সাঁজোয়া যানের আওয়াজ, গুলির শব্দ, গোলার বিস্ফোরণ আর মানুষের আর্তচিৎকারে ঢাকা বিভীষিকার শহরে পরিণত হয়।

 

সেনাবাহিনী পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধ্বংসী হামলা চালায়। খুঁজে খুঁজে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। সে রাতে জগন্নাথ হলে ৩৪ জন ছাত্র শহীদ হয়।(৩)এদিকে পিলখানায় এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি সেনা ও পুলিশরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেও তাদের ভারি অস্ত্রের মুখে বেশিক্ষণ টেকেনি। সেনাবাহিনী রাত দুইটার পর ইপিআর হেডকোয়ার্টার এবং ভোরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস দখল করে।

 

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক কোয়ার্টার, ইপিআর ও পুলিশ ব্যারাকসহ আবাসিক এলাকা ও বস্তির বাসিন্দাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালিয়ে সেনাবাহিনী নজিরবিহীন গণহত্যার সূচনা করে। তারা নির্মমভাবে হত্যা করে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে। ট্যাংকের গোলায় বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখায় ঢাকা শহর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এদিকে রাত ১০টায় ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ইপিআর সেক্টরের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। রফিকুল ইসলাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারের বাঙালি সেনাদের নিয়ে সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।(৪)

 

২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১টায় পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের কাছে ব্যারিকেড ভেঙে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে গ্রেফতার করে বাঙালির প্রাণের এই নেতাকে। গ্রেফতারের পূর্বেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।(৫) পিলখানা, ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে পাঠানো হয় ম্যাসেজ আকারে। এই ঘোষণার পরই লাল সবুজের পতাকাখচিত একটি মানচিত্রের জন্য শুরু হয় মুক্তিকামী বাঙালির চুড়ান্ত আন্দোলন।

 

তথ্যসূত্রঃ

(১) একাত্তরের দিনপঞ্জি- মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, পৃষ্ঠা-৫৭

(২) বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর দুই, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার(২০০৬)

(৩)একাত্তরের দিনপঞ্জি- মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, পৃষ্ঠা-৫৮/

(৪) লক্ষ প্রানের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, অনন্যা, ঢাকা(২০১৪) পৃষ্ঠা-১১২-১৪৫

(৫) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা (২০২০), পৃষ্ঠা-১৯১

- Advertisement -
spot_img

আলোচিত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ

ভিডিও