বুলেট গতিতে ছুটছে ভারতের অর্থনৈতিক চাকা। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জিডিপি বৃদ্ধির হার। বিশেষজ্ঞদের অনেকের ধারণা, ২০২৯ সালের মধ্য়েই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে ভারত। ২০২৫ সালে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জাপানের জিডিপিকে ছাড়িয়ে যাবে ভারতের জিডিপি। ধারণা করা হচ্ছে—আগামী বছর জাপানের জিডিপি হবে চার দশমিক ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, ভারতের জিডিপি হবে চার দশমিক ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু ভারতের এই সাজানো গোছানো অর্থনৈতিক অবস্থান কি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে? নাকি যেভাবে দ্রুত গতিতে উত্থান হয়েছে সেভাবেই ভেঙ্গে পড়বে। এ নিয়েই চলছে নানা আলোচনা, সমিক্ষা আর গবেষণা।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের বেশিরভাগ সময় ধরে ভারতের অর্থনীতি গোটা দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আপাতদৃষ্টিতে একটি গরিব দেশ থেকে সেখানে উচ্চ প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু ২০০৮ সালে দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দায় ভারতের দীর্ঘ তিন দশকের কাঠামোগত রূপান্তর ধাক্কা খায়। সর্বশেষ করোনা মহামারির তাণ্ডবে ভারত আবারো বাঁধাপ্রপ্ত হয়। কিন্তু করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই যেখানে পিছিয়ে; সেখানে ভারত এগিয়ে চলছে অবিশ্বাস্য ভাবে। জাপান ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশও যেখানে মন্দার কবলে পড়েছে। সেই সময় প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেল ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে ভারতে ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
২০১৪ থেকে ২০২৩ এই দশ বছরে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটি এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বৃহত্তম অর্থনীতির তালিকায় আরও উপরে উঠে আসবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশটি। এমনকি ২০২৭ সালের মধ্যে দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বড় অর্থনীতির দেশ হতে পারে। তখন ভারতের সামনে থাকবে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ।
ভারতের অর্থনীতির এই অভাবনীয় অগ্রগতির পেছনে আছে দেশটির বিপুল অভ্যন্তরীণ চাহিদা। জাতিসংঘের হিসাবে গত বছর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ভারতের জনসংখ্যা। আবার ইনফোসিস, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস ও উইপ্রোর মতো তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি দেশটিকে একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে হাজির করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভারত বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশটিতে এখনো আধা-গ্রামীণ পরিবেশ রয়ে গেছে। সেখানে কোটি কোটি মানুষ ডিজিটাল সেবা নিলেও ২০২৩ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) ভারতের অবস্থান ছিল ১২৫ দেশের ১১১তম।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ভারতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তারা দাবি করেছে,দেশটির জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশই রয়েছে দেশের ১% ধনকুবেরের হাতে। যা আসলে দেশটির অর্থনৈতিক বিশাল অগ্রগতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। ২০২২-২৩ সালে ভারতে ধনীদের ১ শতাংশের উপার্জন ও সম্পদ সর্বোচ্চ হয়েছে। ওই ১ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে দেশের মোট উপার্জনের ২২.৬ শতাংশ এবং মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। ওই ধনকুবেরদের উপার্জন এবং সম্পদ বিশ্বের মধ্যেও শীর্ষে। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, এমন কী আমেরিকার মতো দেশগুলির থেকেও এগিয়ে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ সুনেত্রা ঘটক বলেন, কিছু মানুষের হাতে আয় এবং সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে। এটা বস্তুত পক্ষেই একটা বৈষম্যমূলক পরিবেশের চিত্রের প্রতিফলন। এই বিষয়টা কোনও দেশের পক্ষেই ইতিবাচক নয়। তার মতে এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
এদিকে ভারতের আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন গভর্নর ডি সুব্বারাও। তিনি বলেছেন, অর্থনীতি উন্নত হলেও দরিদ্র দেশ হিসেবেই থেকে যাবে ভারত। তাঁর কথায়, ধনী দেশ মানেই উন্নত জাতি নয়। সেটা সৌদি আরবের দিকে তাকালেই স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। বিপুল জনসংখ্যার কারণেই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে চলেছে। কিন্তু এতে দেশটির দারিদ্রতা কমবে না। ডি সুব্বারাওর মতে, ব্রিকস এবং জি টুয়েন্টি ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভারত সবচেয়ে গরিব। তার কথার সাথে ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের তথ্যের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। দেশটিতে এমন পরিস্থিতির কারণ হচ্ছে বৈষম্য। যা স্থায়ী ভাবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে বাঁধা সৃষ্টি করবে। ইনকাম অ্যান্ড ওয়েলথ ইনিকুয়ালিটি ইন ইন্ডিয়া-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের আধুনিক বুর্জোয়াদের নেতৃত্বাধীন কোটিপতি রাজ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজের চাইতেও বেশি অসম।
জাপান টাইমসে বলা হয়েছে, চীনে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলো থেকে ভারতে বিনিয়োগ আসছে। সর্বোপরি ভারতের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার, ইংরেজি ভাষাভাষী ও দক্ষ পরিচালকদের সরব উপস্থিতি, অল্প বয়সী, স্বল্প-দক্ষ বিপুল সংখ্যক কর্মীদের জন্য দেশটিতে রফতানি পণ্য উৎপাদনের জন্য যথোপযুক্ত বলে মনে করা হয়। কিন্তু এত সুযোগ পাওয়ার পরও দেশটিতে বৈষম্য কমছে না।
সংকট মোকাবিলায় একের পর এক উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে ভারত। ধীরে ধীরে ঋণের সমস্যাও কাটছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি ঘুরে দাঁড়িয়েছে? বৈষম্য কমিয়ে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হাটছে? এর উত্তর দেওয়া কঠিন হলেও নিঃসন্দেহে ভারত সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সাফল্যের ‘হার্ডওয়্যার’ নির্মাণে চিত্তাকর্ষক অগ্রগতি করেছে। দেশটিতে ভৌত ও ডিজিটাল পরিকাঠামো রয়েছে। মৌলিক পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। রয়েছে দক্ষ প্রকৌশলী ও উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী ভিত্তি।
কিন্তু ভারতের হঠাৎ হঠাৎ নীতির পরিবর্তন বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। তাই ভারতীয় অর্থনীতির সম্ভাব্যতা অর্জনের জন্য সরকারের নীতিতে একটি সুস্পষ্ট নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন। কিন্তু এমন কিছু ঘটার ইঙ্গিত নেই। ভারত যদি এখন তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে মৌলিকভাবে উন্নত করতে না পারে এবং নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় আস্থা তৈরি করতে না পারে তাহলে দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশি সংস্থাগুলো দেশটির অর্থনৈতিক গতিপথ পরিবর্তনের জন্য বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না। এছাড়াও আরও ঝুঁকি আছে দেশটিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ও উদারনীতির প্রতি সরকারের ক্রমবর্ধমান অবলম্বন সামাজিক স্থিতিশীলতা, বিচার বিভাগ, মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অখণ্ডতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
এই জটিলতাগুলোর প্রভাব বেশি হলে ভারতের অর্থনীতিতে আবারও একটি হতাশাজনক দশক আসতে পারে। অবশ্যই, কিছু পরিমাণে প্রবৃদ্ধি, কিছু খাত এবং জনসংখ্যার একটি অংশের সমৃদ্ধি হতে পারে। আর মূলত হচ্ছেও তাই। কিন্তু বৃহৎ অর্থে সমগ্র ভারতীয়ের জীবনমান উন্নত হচ্ছে না। এমনটি চলতে থাকলে, মোদি সরকারের বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্বসূরিদের মতো অধরাই থেকে যাবে।