সন্ধ্যা নামলেই ঘুমিয়ে পড়া। মানুষের আনাগোনা তো বটেই, বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাটও। যেন হুমায়ূন আহমেদের সেই উপন্যাস- ‘কোথাও কেউ নেই’! এই হলো শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডির উপ শহর পাল্লেকেলের রোজকার দিন। আজ সেই শীতল-শান্ত শৈল শহরেই কিনা সমস্ত উত্তাপ। সূর্য ডুবলেই অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া পাল্লেকেলের সেই গলি পথ হয়তো জেগে থাকবে আলোর মিছিলে। কখনো রব উঠবে “ভারত ভারত”, কখনো বা “পাকিস্তান জিন্দাবাদ”!
এই সবের উপলক্ষ্য একটাই-আজ যে ক্রিকেট গ্রহের অন্যতম সেরা আকর্ষণ, হ্যালির ধূমকেতুর মতো বহুদিন পর পর ধরা দেয়া ‘ভারত-পাকিস্তান’ ম্যাচ।
উত্তাপ, বৈরিতা, লড়াই। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই বহুবছর ধরে সামনে আসে এই শব্দগুলো। এশিয়া কাপে আজ মহারণের আগেও সেই শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে দিল্লী থেকে ইসলামাবাদ, ঢাকা থেকে ক্যান্ডিতে। ক্ষণে ক্ষণে তাই প্রশ্ন উঠছে সম্মান রক্ষার এই লড়াইয়ে জিতবে কে? ভারত নাকি পাকিস্তান!
পরিসংখ্যান বলছে স্পষ্ট এগিয়ে ভারত। কেননা এক দিনের খেলায় দুই দলের সর্বশেষ পাঁচ সাক্ষাতে চারবারই জয়ী বিরাট কোহলির ভারত। কখনো বিশ্বকাপের মঞ্চে, কখনো এশিয়া কাপ, কখনো বা আবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফি-বারবার বাবর আজমদের হৃদয় ভেঙেছে ভারত। অবশ্য এটিও মনে রাখতে হবে এই হারগুলো কোনোটিই ‘ফাইনালে’ ছিল না। শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে শেষ জয়টি কিন্তু পাকিস্তানেরই। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ওভালের সেই ফাইনালে ভারতকে ১৮০ রানে নাস্তানাবুদ করেছিল পাকিস্তান।
তাই আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তানের সামনে আগেভাগেই হার শব্দটি লাগানো যাবে না। তার ওপর কদিন আগেই পাকিস্তান ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের চূড়ায় উঠেছে। বোলিং তো বটেই পাকিস্তানের এখনকার ব্যাটিং লাইনআপও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। ওয়ানডে ব্যাটারদের র্যাংকিংয়ের সেরা পাঁচজনের তিনজনেই যে পাকিস্তানের। ফলে ভারত পাকিস্তানকে হেলায় হারিয়ে দেবে-সেটি বলার সুযোগ এবার একেবারেই কম।
ভারতের ব্যাটিং নাকি পাকিস্তানের বোলিং:
বরাবরই বোলিং দর্পে সাম্রাজ্য জয় করেছে পাকিস্তান। ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিস বহুবছর ধরে ইতিহাসের পাতায়। মোহাম্মদ আমির-ওয়াহাব রিয়াজরাও অতীত।
তাতে কি? পাকিস্তানের পেস বোলিং যেন এখন আরও সমৃদ্ধ। শাহিন শাহ আফ্রিদির বাইরে থেকে স্ট্যাম্পের দিকে তেড়ে আসা মরণঘাতী বল, সুইং আর সিমের নড়াচড়ায় অনবদ্য নাসিম শাহ আর ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার গতিতে হ্যারিস রউফের আচড়ে ফেলা গোলা। অতীতে রোহিত শর্মা, কে এল রাহুলদের বিভ্রান্ত হয়ে আউট হতে দেখা গেছে শাহীনের বলে। এবার নিশ্চয় শাহীনের শুরুর কয়েকটা ওভার ঠেকিয়ে দেয়ার রসদ নিয়েই নামবেন রোহিতরা।
চিরকাল ব্যাটিং শক্তি নিয়ে গর্ব করা ভারত অবশ্য এবার কিছুটা পিছিয়ে। চোটে পড়ায় একঝাঁক ক্রিকেটারের সেবাবঞ্চিত রোহিতের দল। ঋশভ পন্থের মতো প্রতিভা তো নেই বহুদিন ধরে। কে এল রাহুলকেও আজ পাচ্ছে না ভারত। সদ্য চোট সারিয়ে দলে ভেড়া শ্রেয়স আইইয়ার যে বিশেষ কিছু করে বসবেন, সেটা ভাবাও কঠিন। সেজন্য তারুণ্যনির্ভর ব্যাটিং লাইনআপের হাল ধরতে হবে রোহিত আর বিরাটকেই। অবশ্য নিজেদের দিনে এই দুই ব্যাটার যে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন, তা দেখা গেছে বারবার। সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রায় জিততে বসা ম্যাচ কীভাবে একা হাতে পাকিস্তানের কাছ থেকে বিরাট কেড়ে নিয়েছিলেন তা তো সদ্য অতীত। সুতরাং বিরাট-রোহিতের সামনে কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে পাকিস্তানের বোলিং লাইনআপকে।
যদিওবা বোলিং আক্রমণেও সাদা চোখে এগিয়ে আছে পাকিস্তান। তিন পেসারের কথা তো বলা হলোই, তাদের সঙ্গে সাদাব খানের লেগ স্পিনের সঙ্গে বাঁহাতি মোহাম্মদ নওয়াজের বৈচিত্র্যও আছে। ভারত অবশ্য বহুদিন পর জাসপ্রীত বুমরাহকে ফিরে পেয়েছে। তার সঙ্গে মোহাম্মদ শামী, মোহাম্মদ সিরাজরাও আছেন। বুমরাহ সদ্য চোট থেকে ফিরেছেন, আয়ারল্যান্ডে ভালো বোলিংও করেছেন। তবু বহুদিন ধরে চোটের সঙ্গে লড়াই করে আসা বুমরাহকে নিয়ে ভারতের সমর্থকদের একটু ভয় থাকবেই।
কিন্তু ম্যাচটা যেহেতু ভারত-পাকিস্তান এখানে ব্যাট বলের সঙ্গে চলবে স্নায়ুর লড়াইও। সেটিতে যারা এগিয়ে থাকবে তাদের নামের শেষেই হয়তো দিনশেষে লেখা থাকবে-জয়!
ইদানীং ‘শত্রুর’ চেয়ে দুই দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে বন্ধুত্বের জয় গানটাই বেশি বাজছে। অতীতে ভারত পাকিস্তান ম্যাচ শুরুর আগেই দুই দলের ক্রিকেটাররা তো বটেই সাবেকরাও নেমে পড়তেন কথার লড়াইয়ে। এখন যেন সেই চিত্র অতীত। প্রতিপক্ষকে ঘিরে সংযত কথা তো বটেই সমীহও দেখা যাচ্ছে খুব।
ভারতের সাবেক কোচ রবি শাস্ত্রী যেমন দুই দলের দ্বৈরথ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ভারতকে ফেভারিট বললেও পাকিস্তানকেও পিছিয়ে রাখলেন না। শাস্ত্রী বলেছেন, ‘আমি ভারতকেই ফেভারিট বলব। ২০১১ সালের পর থেকে এটিই তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। তবে এটাও বলতে হবে, পাকিস্তান ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। সাত-আট বছর আগে দুই দলের শক্তিমত্তা, খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা ব্যবধান ছিল। তবে পাকিস্তান সেটি কমিয়ে এনেছে। তারা খুবই ভালো দল। তাদের হারাতে হলে সেরাটা দিতে হবে।’
প্রায় একইভাবে পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখলেও ভারতকে ‘ছোট’ করেননি শোয়েব আখতারও।
আর রাজনৈতিক বৈরিতায় প্রতিবেশী হয়েও দুই দেশের মধ্যে ‘হাজার মাইলের’ দূরত্ব থাকুক ক্রিকেটাররাও সেটি গায়ে মাখছেন না। সার্বিক পরিস্থিতি কিন্তু সেটাই বলছে। কদিন আগে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর যেমন বিরাট কোহলিকে প্রশংসায় ভাসালেন। কোহলির পরামর্শ তার ব্যাটিংয়ের উন্নতিতে কীভাবে সাহায্য করেছে, সেটি কোনো রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ করলেন। তার আগে পাক অধিনায়ককে বিরাট তো সনদই দিলেন এই বলে, ‘সব ফরম্যাট মিলিয়েই সম্ভবত বর্তমানে বিশ্বের সেরা ব্যাটার। ধারাবাহিকভাবে সব ফরম্যাটেই সে পারফরম্যান্স করে। তাকে খেলতে দেখাটা আমি সব সময়ে উপভোগ করি।’
এই যেমন আজ মহাযুদ্ধের আগেও, ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনুশীলনের ফাঁকে বিরাট-শাহীনের হৃদ্যতা, রউফ-সিরাজের খুনশুটি।
শুধু কি বিরাট-বাবরেরা। দেশগত বিদ্বেষকে ভারত মহাসাগরের জলে ডুবিয়ে দুই দেশের সমর্থকেরাও যেন আজ সবার আগে একটা ভালো ম্যাচ দেখতে চান। হানাহানি, মারামারি, হিংসা-পাল্লেকেলের আকাশে সেই অসুস্থ মেঘগুলোর অস্তিত্ব নেই আজ।
সবুজ মখমলের মতো পাল্লেকেলের আকাশে যদিও আজ নাকি থাকবে প্রকৃতির কালো মেঘ! যে মেঘ কিনা বৃষ্টি হয়ে ঝরে ভেসে দিতে পারে পুরো ম্যাচ!
দুই দলের ক্রিকেটার আর সমর্থকদের তাই একটাই প্রার্থনা আজ-খেলাটা হোক ঠিকঠাক। হারি-জিতি নাহি লাজ…