পাকিস্তান-পূর্ব ভাষা বিতর্কের ধারাবাহিকতায় নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী করাচিতে ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভ-সমাবেশ, ছাত্র ধর্মঘট, প্রাদেশিক আইন পরিষদ ঘেরাও ইত্যাদি কর্মসূচি শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল।
পাকিস্তানে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত ছিল না। বরং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের এই অগণতান্ত্রিক, পক্ষপাতমূলক ভাষানীতি ও রাজনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার ছাত্র, যুবক, রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এগিয়ে আসে। প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিভিন্ন সংগঠন।
এর মধ্যে কামরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত গণ-আজাদী লীগ (জুলাই ১৯৪৭), তসাদ্দক আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক যুব লীগ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৭), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত তমদ্দুন মজলিশ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৭), একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে (পরবর্তীকালে শামসুল আলম) আহ্বায়ক করে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (অক্টোবর ১৯৪৭) এবং তৎকালীন যুবনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮) বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসব সংগঠন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার তারিখ স্থির হয়। এদিকে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবিতে পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভ-সমাবেশ, ঘেরাও কর্মসূচি অব্যাহত থাকে। যেমন ২৬শে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ছাত্র ধর্মঘট, ১১ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’-এ ঢাকা বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘট, ১৩ই মার্চ ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ই মার্চ রাজপথে পিকেটিং করতে গিয়ে সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখ থেকে বঙ্গবন্ধুসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদের মধ্যে অন্যতম।
এমনই এক পরিস্থিতিতে ১৪ই মার্চ পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে একটি ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দফাসমূহ হলো-
১. ২৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাঁহাদিগকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে।
২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।
৩. ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং একে পাকিস্তান গণপরিষদ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাদিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে ।
৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠিয়া যাইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা।
৫. আন্দোলন যাঁহারা অংশগ্রহণ করিয়াছে তাহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।
৬. সংবাদপত্রের ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।
৭. ২৯শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার যেসব স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।
৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নাজিমউদ্দিন সরকারের আর লক্ষ্য ছিল উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে জিন্নাহর ঢাকা সফরকে নির্বিঘ্ন করা। তবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আগমনের পর ২১শে মার্চ (১৯৪৮) রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ভাষা-প্রশ্নে জিন্নাহ এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। তাঁর এ ঘোষণার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানানো হয়। এরপর ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়ে যাওয়া ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি ভাষাসংক্রান্ত তাঁর পূর্বঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলে সেখানেও প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়।