“আমার কী হয়েছে আমি নিজেই জানি না,কিন্তু কিছু একটা হয়েছে।কী হয়েছে আমার ?”
বা কখনো,”আমি না অনেক ডিপ্রেশনে আছি।“আমরা উঠতে বসতে অহরহ এই কথা গুলো শুনে থাকি। বিশেষ করে এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে এই কথা গুলো যেনো অনেক বেশি দৈনন্দিন হয়ে যাচ্ছে।আসুন আমরা জেনে নেই এই মানসিক সমস্যাটা আসলে কী?
আজ থেকে কয়েক দশক আগেও আমরা ভাবতাম যারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় বদ্ধ উন্মাদের মতো তারাই হয়তো পাগল বা মানসিক রোগী। এদেরকে রাখা হতো কোনো মানসিক হাসপাতালে। তবে দিন বদলের সাথে সাথে মানসিক সমস্যাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১. মানসিক অসুস্থতা (Psychotic Illness)
২. স্নায়বিক অসুস্থতা (neurotic Illness)
উদাহরণস্বরূপ, বিষণ্নতায় আক্রান্ত একজন রোগী যিনি বিশ্বাস করেন যে তার একটি মানসিক অসুস্থতা রয়েছে সে স্নায়বিক, যেমন একজন রোগীর বিপরীতে যিনি বিশ্বাস করেন যে সবাই তাকে পেতে এসেছে এবং বিশ্বাস করে যে তার পরিবার তাকে সমর্থন না করলেও সে সঠিক। স্নায়বিক রোগীরা প্রায়শই নিজে থেকে ডাক্তারের কাছে যেতে চান এবং নিজে থেকে ওষুধ খেতে চান, যেখানে সাইকোটিক রোগীরা ডাক্তারকে দেখতে চান না বা নিজে থেকে ওষুধ খেতে চান না।
দেহ এবং মন দুইয়ে মিলে মানুষ সৃষ্টি হয়। সুতরাং যদি দেহ বা মন যেকোনো একটি খারাপ হয়ে যায় তাহলে মানুষের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের মন যখন আক্রান্ত হয় তখন আমরা সেটিকে মানসিক সমস্যা বলে থাকি। এটি বিভিন্ন ভাবে হয়ে থাকে।
যেমনঃ ডিপ্রেশন,অ্যাংজাইটি,সিজোফ্রেনিয়া,ইত্যাদি।
গবেষণা মতে, একক কোনো কারণে মানসিক সমস্যার উদ্ভব ঘটে না। নানাবিধ কারণ এর পেছনে দায়ী। যেমন : জিন ও ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে মানসিক রোগ হয়। সিজোফ্রেনিয়ার জন্য ত্রুটিপূর্ণ জিন দায়ী। নিউরোট্রান্সমিটার ত্রুটির ফলে অস্বাভাবিক আচরণ তৈরি হয়। শিশু মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় বা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পর মস্তিষ্কে আঘাত পেলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা হয়। মনস্তাত্ত্বিক কিছু কারণও আছে।
যেমন: শৈশবকালীন দ্বন্দ্ব, ত্রুটিপূর্ণ আচরণ শিক্ষণ, ভ্রান্তবিশ্বাস, আত্মক্ষমতার অভাব, পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা, মানসিক চাপ ইত্যাদি।
আমাদের দেশে ঠিক যতোটুকু ভাবে দৈহিক সমস্যা গুলো গুরুত্বের সাথে দেখা হয়।ঠিক একই ভাবে মানসিক সমস্যা গুলো ওভাবে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় না।কিন্তু আমাদের এই ধারণাটি ভুল। আমাদের সকলেরই ঠিক ততোটুকুই মানসিক অবস্থায় গুরুত্ব দেয়া উচিত যতোটুকু আমরা দৈহিক সমস্যাতে দেই।
২০১৯ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় উঠে আসে, প্রতি আট জন লোকের মধ্যে এক জনের মানসিক রোগ বিদ্যমান। ঐ একই সংস্থার ২০২০ সালের পরিচালিত গবেষণার ফলে দেখা যায়, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অ্যাংজাইটি এবং ডিপ্রেশন আগের চেয়ে অনেক মাত্রায় বেড়ে গেছে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশের মানুষও পিছিয়ে নেই। শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ যেকোনো বয়সের মানুষই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। একেকটা মানসিক রোগের ধরন ও লক্ষণ একেক রকম। তবে এগুলোর সবই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আসুন দেখে নেয়া যাক, আমাদের দেশের এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কীভাবে এই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে?
আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলে মেয়ে সোশাল মিডিয়া গুলোতে খুবই অ্যাক্টিভ । তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন নামক জিনিসটি অনেক বাজে ভাবে প্রভাব ফেলেছে।তারা যেকোনো কিছু নিয়ে ডিপ্রেশনে পরে যায়।তাদেরকে সঠিক কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে তাদের এই সমস্যা থেকে উঠিয়ে আনা যাবে। যেমন তাদের জন্য যেকোনো জীবন সংক্রান্ত মোটিভেশন স্পিচের আয়োজন করা যেতে পারে। যেকোনো পাব্লিক স্পিকিং ইভেন্টও তাদের জন্য সহায়ক হতে পারে।তাছাড়া প্রতিটা স্কুল,কলেজ,বিশ্ব-বিদ্যালয়ে যদি সাইকোলজিক্যাল স্পেশিয়ালিস্ট রাখা হয় তাহলে প্রতিটা ছেলে মেয়ে তাদের মানসিক অবস্থা অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এতে আমাদের দেশে সুইসাইডের হারও কমে যাবে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেঘলা সরকার বলছেন, ”যখন কোন ব্যক্তির আচরণ, ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়, বিশেষ করে তার আবেগীয় প্রকাশের পরিবর্তন আসে এবং সেটা তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে, সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে শুরু করে, তখনি তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।”
তাছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলছেন, আমাদের সবার মধ্যে কিছু কিছু আচরণের অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে। সেটা হলেই সবাইকে মানসিক রোগী বলা যাবে না। কিন্তু তার এই মনের অবস্থার কারণে যদি তার স্বাভাবিক বা প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে থাকে, তখনি বুঝতে হবে যে, সে হয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
তাই আমাদের দেশে মানসিক সমস্যাকে অভিশাপ মনে না করে সবার এগিয়ে আসা উচিত। সবাইকে মানসিক সমস্যার ব্যাপারে অবগত করা উচিত। কেননা আজকের প্রজন্মই আগামী দিনের ভবিষ্যত তাই আমরা যদি আজকের প্রজন্মকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে না পারি তবে ভবিষ্যতে আমাদের একটি বড়ো হুমকির সম্মুখিন হতে হবে।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি আরকাইভ অনলাইন-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।