সপ্তদশ শতকের থেকে গত শতক পর্যন্ত (প্রায় ৩০০ বছর) পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাকি অংশকে শোষণ করতো। একচেটিয়া ভাবে এই কাজটি করে গিয়েছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ – বেলজিয়াম, হল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড। অন্যদের শোষণ করার জন্য এই দেশগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ সৃষ্টি করে। একসময় ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। দীর্ঘ ৩০০ বছর ধরে এই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পুরো বিশ্বের সব সম্পদ লুণ্ঠন করে ইউরোপে নতুন নতুন শহর, বন্দর, সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পাশাপাশি উন্নয়ন ঘটিয়েছে নতুন নতুন অবকাঠামোর।
তবে এসব সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা না থাকলে, হিটলারের নাৎসিবাদ সহজে প্রতিরোধ করা যেত না। তবে ইউরোপের উত্থান, বিস্তার ও অর্থনৈতিক শক্তির অগ্রগতি দেখে যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের উপনিবেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। যা গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্নমুখী কার্যকলাপের মধ্যে ফুটে উঠেছে। ৫০ এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নতুন এক মডেলের উপনিবেশ সৃষ্টি করা শুরু করে। নতুন এই মডেলের মাধ্যমে তাদের পছন্দমতো যে কোনো দেশে নিজস্ব বংশবদ ও কিছু তাঁবেদারকে ক্ষমতায় বসিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করতো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সম্পদ লুট করে তাদের দেশের ব্যবসায়িক স্বার্থ করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র একসাথে হিটলারের নাৎসিবাদের আগ্রাসন রুখে দিতে নিজ দেশের মানুষের রক্ত ঝরিয়ে যুদ্ধ করেছে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, যুক্তরাষ্ট্রের এই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিশ্বের শোষিত মানুষদের মুক্তির মন্ত্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে আসে সমাজতন্ত্রের দর্শন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চালিয়ে যেতে থাকে তাদের পুঁজির আধিপত্যের দর্শন। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক উপনিবেশ এই সময়ে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে নিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় দেশগুলোর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতে, যে দেশের সম্পদ সেই দেশের জনগণের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু সেসব দেশের সম্পদকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কারোর নেই। এভাবেই পুরো বিশ্বব্যাপি সূচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উপনিবেশবাদের যা বাস্তবায়িত হয় মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দ্বারা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এগিয়ে এলো তাদের সার্বিক সহায়তা করতে। শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিদেশনীতি যার মূল প্রতিপাদ্য, কোনো রাষ্ট্র যদি তাদের তাঁবেদার হতে অস্বীকার করে তাহলে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সেখানে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে ক্ষমতাসীন বৈধ সরকারকে উৎখাত করা হবে। প্রয়োজনে সরকার প্রধানকে হত্যাও করা হবে যার শুরু করে ইরানকে দিয়ে।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য বেশ সক্রিয়। আমাদের দেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র মেরামত করতে চায় বলে সে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা প্রায় বাংলাদেশে সফর করছেন। নব্বইয়ের দশকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাদের অপকর্মের দায়িত্ব নিজেদের সৃষ্ট সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের এসব সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে বিএনপি জামায়াত একসাথে দেশে ভয়াবহ সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল নির্বাচন বানচালের জন্য। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল বিএনপি। বাংলাদেশের এই ২ বছর বা এর আগের কোনো বছরের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ বর্তমানের মতো উদগ্রীব হয়নি। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ থেকে অযাচিত হস্তক্ষেপের পেছনে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের আভাস রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল। জিয়ার আমলে অর্থাৎ ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৫, ২০০১, ২০০৪, ২০১৩, ২০১৪ সালেও লঙ্ঘিত হয়েছিল আমাদের দেশের মানবাধিকার। তবে সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের নিরবতা বিস্মিত করেছিল সবাইকে। বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব থেকে জানা যায়, অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩৫; যা ২০২৭ সালে ২৭তম স্থানে উঠে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০৩০ সালে বিশ্বের বৃহৎ ভোগ্য পণ্য বাজারের ৯ম স্থানে বাংলাদেশ থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র এসব অগ্রগতির সুফল ভোগ করতে চাওয়া নতুন কিছুই নয়।
আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার পরিধি। যার মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬টি তেল গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লক। এই সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য যেসব উচ্চ সক্ষমতা সম্পন্ন প্রযুক্তি প্রয়োজন তা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর রয়েছে। তবে গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রভাব পূর্বের তুলনায় কমেছে। অন্যদিকে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীনের প্রভাব। ভারত ও চীনের সম্পর্কে কিছুটা ফাটল দেখা দিলেও বৃদ্ধি পেয়েছে বাণিজ্যিক লেনদেন। ভারতের আমদানি প্রায় ২৫ শতাংশই আসে চীন থেকে। এইদিকে বিশ্ববাজারে চীনের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ভোগ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে।
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার রোধে যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের কর্মসূচি প্রণয়নের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে একটি হলো চার দেশীয় নিরাপত্তা জোট “কোয়াড”। এই জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান। বাংলাদেশকেও এই জোটের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ তার নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতিতে অটল থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার নিজস্বনীতি ঘোষণা করেছে।
তবে বর্তমানে সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমহ্রাসমান আধিপত্যের প্রবণতা লক্ষণীয়। এটি হতে পারে মূল কারণ বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের এমন হস্তক্ষেপ ভবিষ্যতে হতে পারে ভয়াবহ ধ্বংসের সূচনা। এমন কোনো পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের থাকলে ,এটি হবে সবচেয়ে বড় বোকামি। কারণ বাংলাদেশ সবসময় চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে, নিজ নিজ অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থ অর্জন করতে। মার্কিন সাম্রাজ্য যেখানে ছোটো হয়ে আসছে সেখানে শুধুমাত্র স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে তাদের সাম্রাজ্য আরো ছোটো হয়ে আসতে দেওয়া উচিত নয়।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি আরকাইভ অনলাইন-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।