
মোশতাক শাসনামল (১৫ই আগস্ট-৩রা নভেম্বর ১৯৭৫)
ক. ক্ষমতায় আরোহণ ও গৃহীত পদক্ষেপ

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি মুজিব সরকারের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতায় আরোহণের পর তিনি যে মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেন, এর অধিকাংশ সদস্যই বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাই প্রথমে এটিকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ কর্তৃক ক্ষমতা দখল বলে প্রচারের চেষ্টা করা হয়। সম্ভবত একই ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংবিধান, জাতীয় সংসদ কিছুই বাতিল ঘোষণা করা হয়। নি। ক্ষমতায় আরোহণের পরপর শুধু বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে মুজিব-সৃষ্ট রাজনৈতিক দলটি বাতিল ঘোষণা করা হয়। এমনকি ট্যাংকে চড়ে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাসীন হলেও তখনই মার্শাল ল বা সামরিক আইন জারি করা হয় নি। ক্ষমতা দখলের পাঁচ দিন পর, অর্থাৎ ২০শে আগস্ট তা জারি করা হয়।
১৫ই আগস্ট খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে প্রতিবিপ্লবী শক্তি ক্ষমতায় আসীন হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিপ্লবের সময় মোশতাক পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘কনফেডারেশন’ ব্যবস্থাধীনে যুক্ত থাকার পক্ষে ছিলেন। এ সম্বন্ধীয় বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। মোশতাক যে ১৫ই আগস্টের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, তাতেও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতির ওই পদে আসীন হওয়ার কথা। সে সময়ে উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মোশতাক বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন মাত্র, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কথা সবার জানা যে, ১৯৭৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে সংবিধান, আইনের শাসন ও মানবতাবিরোধী একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা যুক্ত, তাদের স্বীয় কৃতকর্মের জন্য ভবিষ্যতে সম্ভাব্য বিচারের হাত থেকে রেহাই দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য (১৯৯৬ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (বহিতকরণ) আইন’ পাসের মাধ্যমে তা বাতিল হয়ে যায়।
খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে জাতীয় সংসদের আওয়ামী লীগদলীয় সদস্যদের এক বৈঠক ডেকে তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফলকাম হন নি। এদিকে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে তিনি অন্যান্য পদক্ষেপ নেন। ২২শে আগস্ট বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৪শে আগস্ট জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে তাঁর স্থলে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়। ৩১শে আগস্ট রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে এক অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
খ. সেনা অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান
খন্দকার মোশতাক যেসব সেনাসদস্যের সহযোগিতায় ক্ষমতায় আরোহণ করেন, শীঘ্রই তাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের সরাসরি বিরোধ দেখা দেয়। ১৫ই আগস্টের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত জুনিয়র সেনা অফিসাররা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে না গিয়ে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভবনে অবস্থান করে সেখান থেকে দেশ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। ৩রা নভেম্বর তাঁর নেতৃত্বে এক সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ওই দিনই কার্যত খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে, যদিও ৫ই নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করা হয়। এভাবে খন্দকার মোশতাক মাত্র ৮৩ দিন ক্ষমতায় থাকার পর তাঁর স্বল্পকালীন শাসনের অবসান ঘটে। ৬ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এস এম. সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
গ. মোশতাকের ক্ষমতাচ্যুতি
খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যখন ৩রা নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হচ্ছিল, ঠিক এরই পাশাপাশি সে সময় খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সেনাসদস্যরা ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে বন্দী অবস্থায় থাকা জাতীয় চার নেতাকে অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। সংঘটিত হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেক কলঙ্কময় অধ্যায়। খন্দকার মোশতাক ও তাঁর সহযোগীদের আশঙ্কা ছিল, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুজিবের রাজনৈতিক পুনরুত্থান ঘটবে। সে সম্ভাবনাকে নেতৃত্বহীন করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার সহযোগীকে ত্বরিত সিদ্ধান্তে এমনভাবে হত্যা করা হয়। এটি ঠিক যে, খালেদ মোশাররফের ভাই রাশেদ মোশাররফ তখন আওয়ামী লীগদলীয় একজন সংসদ সদস্য ছিলেন। তাই বলে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সংশ্রব ছিল, তা প্রমাণিত হয় না। এ সময়ে খালেদ মোশাররফের ভূমিকা বা আচরণ থেকেও তা স্পষ্ট হয়। যাহোক, ৭ই নভেম্বর পাল্টা এক সেনা অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ কয়েকজন সহযোগীসহ নিহত হন। জেনারেল জিয়ার উত্থান ঘটে।
তথ্যনির্দেশ
১. দ্রষ্টব্য হারুন-অর-রশিদ, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এবং বাংলাদেশের সংবিধান’, এমাজউদ্দিন আহমদ (সম্পাদিত), বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাসঙ্গিক চিন্তা- ভাবনা, ঢাকা ১৯৯২, পৃ. ১০৮-১৪
