বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে এসেছেন বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। পূর্ববঙ্গের সৌন্দর্য, পূর্ববঙ্গের মানুষ তার সাহিত্যে এসেছে বহুবার। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবার পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন ১৮৮৮ সালে। তারপরের বছর। আনে ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে তো পূর্ববঙ্গের জমিদারির দায়িত্বই নিলেন তিনি।
পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর এবং রাজধানী ঢাকা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবদ্দশায় এই ঢাকায় এসেছেন দুইবার। একবার ১৮৯৮ সালে, অন্যবার ১৯২৬ সালে। প্রথমবার ১৮৯৮ সালে (১৩০৫ বঙ্গাব্দ) তিনি ঢাকায় এসেছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের ১০ম অধিবেশনে যোগ দিতে। ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ঢাকা আসা নিয়ে তেমন শোরগোল হয়নি। সেবার তিনি ঢাকায় ছিলেন তিন দিন। ৩০ মে থেকে পহেলা জুন অব্দি এই তিন দিন তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ইন্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটির সভায় রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছিল। সেই প্রতিনিধি দলে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়, লেখক সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয়তাবাদী নেতা ব্যারিস্টার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, প্রখ্যাত শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই সম্মেলনে যোগ দিতে ২৯ মে ঢাকায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জানা যায় অসুস্থ শরীর নিয়েই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সম্মেলনের প্রথম দিন ৩০ মে সম্মেলন শুরু হয়েছিল দুপুর দুটোয় ঢাকায় ক্রাউন থিয়েটার হলে। রেভারেল্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি এই সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি সম্মেলনে ইংরেজিতে ভাষণ দিয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই ভাষণের বাংলা উপস্থাপন করেছিলেন। প্রথমদিনের সম্মেলন শেষ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের “আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না” গানের মধ্য দিয়ে।
দ্বিতীয়দিন অতিথিদের জন্য ছিল বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌ বিহারের আয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ও অতিথিরা সেই নৌ বিহারে যোগ দিয়েছিলেন। বিক্রমপুরের ভাগ্যকূলের জমিদারদের সৌজন্যে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক নৌ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছিলো। সেখানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হয়ে ভাগ্যকুলের ধনাঢ্য জমিদারদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন।
সম্মেলনের শেষ দিন ছিল রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন সমাপণী বক্তব্য দিয়েছিলেন। পরবর্তী বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন ২৪ পরগনায় অনুষ্ঠিত হবে এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। এই সম্মেলনেই বাংলা ভাষা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কবিগুরু। তবে সম্মেলনে একে তো প্রতিনিধির সংখ্যাও ছিলো অনেক কম এবং তার প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন মাত্র তিন জন। সম্মেলন শেষে শিলাইদহ ফিরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখান থেকে তিনি ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির ভাষ্যটা এমন ছিলো যে, “সমস্ত বঙ্গদেশকে এই সমিতি কতদূর একতাসুত্রে বাঁধিতে পারিতেছেন তাহাই প্রত্যেক অধিবেশনের সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ কথা। অথচ এত বৎসর বাঙালির প্রাদেশিক সমিতির তর্ক বিতর্কে বাঙালির ভাষার সম্যক সমাদর লাভ করিতে পারিলো না।”