
ক. রাষ্ট্রীয় মূলনীতি

বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে (অনুচ্ছেদ ৮-১৫) রাষ্ট্র পরিচালনার কিছু মূলনীতি লিপিবদ্ধ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি। এ সম্বন্ধে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়, Ôযে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বyদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।Õ
- জাতীয়তাবাদ
জাতীয়তাবাদ একটি চেতনা। বিভিন্ন উপাদান নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই চেতনা বা ঐক্যবোধ সৃষ্টি, যা অন্যদের থেকে তাদের পৃথক করে, ভিন্ন সত্তা বা পরিচিতি এনে দেয়। জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে বাংলাদেশ সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ৯) বলা হয়, Ôভাষা ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিÕ। অর্থাৎ আমাদের জাতীয়তাবাদ হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এক ও অভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ঐক্য এর ভিত্তি।
2. সমাজতন্ত্র
মানুষের ওপর মানুষের শোষণের অবসান এবং সকলে জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে উৎপাদনযন্ত্র ও উপকরণ এবং বণ্টনব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ন্যস্ত করা হয়। সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ১০) বলা হয়, Õমানুষের শোষণের অবসানসহ একটি ন্যায়ানুগ ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা হবে।Õ এখানে সমাজতন্ত্রের ধারণা ভিন্নতর। সংবিধানের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয় যে, উৎপাদনযন্ত্র ও উপকরণ এবং বণ্টনব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রমালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানা থাকবে। বস্তুত বাংলাদেশের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা-অর্থে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা হয়।
3. গণতন্ত্র
গণতন্ত্র হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্মতির ভিত্তিতে পরিচালিত। গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে বাংলাদেশ সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ১১) বলা হয়, Ôপ্রজাতন্ত্র [বাংলাদেশ হবে] একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা এবং মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্য এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকবে।Õ
4. ধর্মনিরপেক্ষতা
ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। এ দ্বারা অনেকে ধর্মহীনতা বুঝে থাকেন। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ অবস্থান, অর্থাৎ ধর্ম থাকবে, তবে ধর্মের কারণে রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব বা বিরাগ দেখাবে না। বাংলাদেশ সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে কোনোরূপ রাজনৈতিক মর্যাদা দান না করা, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ, (ঘ) এবং কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ বা নিপীড়ন না করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।
5. অন্যান্য মূলনীতি
রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার আরও যেসব নীতি সংবিধানে স্থান পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে কৃষক-শ্রমিক ও জনগণের অনগ্রসর অংশের সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি; অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, কর্মের অধিকার, এক ও অভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি, নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টি, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথককরণ, বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রাম সমর্থন ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
১৯৭৭ সালে এক আদেশ বলে জেনারেল জিয়াউর রহমান Ôজাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণÕ (অনুচ্ছেদ ১০) এবং Ôইসলামি সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্টÕ হওয়াকে (অনুচ্ছেদ ২৫(১) রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।
খ. মূলনীতির পরিবর্তিত রূপ
১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র যে দুই অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ ছিল, সেখানে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে অন্য বিষয় প্রতিস্থাপিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা-সম্পর্কিত ১২ নম্বর অনুচ্ছেদটি সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়। গণতন্ত্রবিষয়ক অনুচ্ছেদটি বহাল থাকে। মূল সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ৮(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যেভাবে লিপিবদ্ধ ছিল, তার পরিবর্তন সাধন করা হয় এভাবে—সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার। লক্ষণীয় যে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পূর্ণ তুলে দিয়ে সেখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন যুক্ত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ কথাটি বহাল থাকলেও এ দ্বারা বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বোঝাবে। সমাজতন্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার এ অর্থে। ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন (অনুচ্ছেদ ২ক)।
গ. মূলনীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্বন্ধে সংবিধানের ৮(২) অনুচ্ছেদে যা বলা হয়— Ôএইভাবে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূল সূত্র হইবে, আইন প্রণয়ন কালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।
আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এর ফলে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির গুরুত্ব খাটো হয় না। এর দ্বারা একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আদর্শ, চরিত্র ও প্রকৃতি ফুটে ওঠে। এ হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের সমুদয় কর্মকাণ্ডের ভিত্তি ও দিকনির্দেশনা। বাঙালির দীর্ঘ জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ও ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা উৎসারিত এবং স্বাধীনতা-উত্তর নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে তা যথার্থ গুরুত্বসহ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
- পরিবর্তনের তাৎপর্য
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পররাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষেপে এ দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আদর্শ-অনুভূতিনির্ভর একটি নতুন আদর্শিক ভিত্তি রচনার প্রয়াস নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সম্বন্ধে ভীতি ও বিদ্বেষ উভয়ই ক্রিয়াশীল। তা ছাড়া অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারী সামরিক নেতৃত্বের জন্য একধরনের বৈধতা অর্জন ও জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সমর্থনবলয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য বা মানসিকতাও এ ধরনের পরিবর্তনে শাসকদের প্ররোচিত করা স্বাভাবিক। সে যাহোক, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির পরিবর্তন মুক্তিযুদ্ধ-সৃষ্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হানার শামিল।
