জন্মভূমির বাইরে ভিন্ন কোনো দেশে গিয়ে প্রবাসীরা তাদের আয়ের যেটুকু অর্থ নিজ দেশে পাঠান সেটাই রেমিট্যান্স। প্রবাসী কর্মীদের হাত ঘুরেই এপার-ওপার হয় বিদেশে অর্জিত আয়। এই রেমিট্যান্স প্রাপ্তির দিক দিয়ে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে ভারত। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে রেমিট্যান্স আয়ে একশ’ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে দেশটি। ২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশটিতে রেমিট্যান্স গেছে ১১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আওএম এর তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স গ্রহণে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে মেক্সিকো। অথচ কয়েকবছর আগেও রেমিট্যান্স গ্রহণে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চীন। কিন্তু ২০২১ সালে চীনকে পেছনে ফেলে মেক্সিকো। দেশটি ২০২২ সালে রেমিট্যান্স পায় ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। রেমিট্যান্স গ্রহণে এখন তৃতীয় দেশ চীন। এরপরের অবস্থান যথাযক্রমে ফিলিপাইন ও ফ্রান্সের দখলে। রেমিট্যান্স পাঠাতে বিশ্বে এখন ষষ্ঠ অবস্থানে পাকিস্তান। আর মিশর সপ্তম অবস্থানে। এরপরই প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক দিয়ে শীর্ষ দশের অন্য দু’টি দেশ নাইজেরিয়া এবং জার্মানি।
রেমিট্যান্স গ্রহণে মাঝখানে কিছুটা ভাটা পড়লেও গড়ে কমবেশি দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসের প্রথম ১০ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৮১ কোটি ৩৭ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দেশে আসছে আট কোটি ১৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। বিদেশে কর্মরত প্রায় দেড় কোটি প্রবাসীর হাত ধরে দেশে আসছে এসব বৈদেশিক মুদ্রা। তবে, দেশে শুধু রেমিট্যান্স আসছে বিষয়টি তেমন নয়। এদেশে কর্মরত অসংখ্য বিদেশির হাত ধরে চলেও যাচ্ছে বড় সংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা। এভাবে এপার-ওপার হচ্ছে চকচকে বৈদেশিক মুদ্রা।
কাজের সন্ধানে প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন লাখো বাংলাদেশি কর্মী। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটি’র তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসে এখন কাজ করছেন প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক। প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও এসব প্রবাসীরাই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মাত্র এক বছরে বিদেশে চিকিৎসক, নার্স, প্রকৌশলী ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতের পেশাদার দক্ষ কর্মী পাঠানো ১৬ গুণ বেড়েছে। সেই তুলনায় কম প্রশিক্ষিত বা অর্ধপ্রশিক্ষিত কর্মী গেছে তুলনামূলক বেশি। এই সংখ্যা দিনদিন বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি রেমিট্যান্স। আবার এসব প্রবাসী কর্মী যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তার সবটুকু আসছে না ব্যাংকের মতো বৈধ চ্যানেলে। অন্যদিকে, অভিবাসী বা প্রবাসী কর্মী পাঠাতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ হলেও রেমিট্যান্সপ্রাপ্তিতে আরও দু’ ধাপ পিছিয়ে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে এদেশের নাম।
বিদেশে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়ে উন্নয়নে বড় অবদান রাখছে প্রবাসে কর্মরত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। বিশ্বের এখন এমন দেশ খুঁজে পাওয়া প্রায় মুশকিল যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা নেই। প্রায় সব দেশ থেকেই কমবেশি রেমিট্যান্স আসছে বাংলাদেশে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। মাসকয়েক আগে সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক দিয়ে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে আমেরিকায় কর্মরত প্রবাসীরা। এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স উৎস হিসেবে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে থাকা ৫/৬ লাখ প্রবাসীর মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স আসার হার প্রায় ১৬ শতাংশ বেড়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবের প্রায় ২৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে করছেন সুসংহত। যদিও আগের তুলনায় সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স আসার হার প্রায় ১৯ শতাংশ কমেছে। তবে, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা দুবাই। চতুর্থ অবস্থানে যুক্তরাজ্য। এরপরেই রয়েছে কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া এবং ওমানের মতো দেশ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসী কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও বৈধপথে রেমিট্যান্স আসা কাঙ্খিত হারে বাড়েনি। প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়াই বৈধপথে রেমিট্যান্স আসা কিছুটা ইতিবাচক হলেও সেভাবে সাড়া পড়েনি। এখনো হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে বড় সংখ্যক প্রবাসী। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর মধ্যদিয়ে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলের ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বেড়ে হয়েছে ১১৭ টাকা। এ সুবাদে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ওপর বাড়তি আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এর প্রভাব বৈধ পথে আসা রেমিট্যান্সের ওপর পড়তে পারে। কমতে পারে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহ। সময়ই বলে দেবে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসায় কতটা ভূমিকা রাখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন এ সিদ্ধান্ত। তবে, রিজার্ভ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফ আগামী জুন নাগাদ বাংলাদেশের টার্গেট কমিয়ে দেয়ায় এ বিষয়ে তেমন মাথাব্যথা থাকার কথাও নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিরা একদিকে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন, অন্যদিকে এদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশিরা। প্রবাসীরা একদিকে দেশে পাঠাচ্ছেন ২২ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স, অন্যদিকে বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছেন কমবেশি ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কারণ এদেশে কর্মরত বিদেশিদের প্রায় শতভাগ কর্মীই দক্ষ এবং উচ্চ বেতনের। ঠিক কী পরিমাণ বিদেশি বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কাজ করছেন এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। পর্যটন ভিসায় এসেও কাজ করছেন অসংখ্য বিদেশি। অনেকেরই ধারণা, কমবেশি দেড় থেকে দুই লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করছে বাংলাদেশে। যদিও সরকারি হিসাব এর ধারেকাছেও নেই। সরকারি হিসাবে, ১১৫টি দেশের ২২ হাজার বিদেশি নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছেন। এদের মধ্যে একক দেশ হিসেবে চীনের নাগরিক সর্বাধিক। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ভারতীয়রা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করে লাখ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স নিজ দেশে পাঠাচ্ছেন বিদেশিরা। এদিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে ভারত। তৈরি পোশাক শিল্পসহ ছোট বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদে কাজ করছেন দেশটির নাগরিকরা। কথিত আছে, ভারতের নাগরিকরাই এককভাবে কমবেশি ৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন বিভিন্নভাবে। রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক দিয়ে শ্রীলঙ্কানরাও পিছিয়ে নেই। এভাবেই এপার-ওপার হচ্ছে রেমিট্যান্স। নিট হিসাবে রেমিট্যান্স আসার হার বেশি হলেও চলে যাচ্ছে প্রায় অর্ধেক।
রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডির মতো অবৈধ পথ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে রেমিট্যান্স বাড়বে। প্রবাসীদের পাঠানো এ আয় বাড়াতে দরকার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে বিদেশে পাঠানো। ভারত বা পাকিস্তানের মতো প্রশিক্ষিত জনবল বিদেশে পাঠানো নিশ্চিত করা গেলে রাতারাতি প্রথম সারিতে উঠতে না পারলেও ৩/৪টি দেশের তালিকায় উঠে আসা কঠিন হবে না। এজন্য রেমিট্যান্সের জন্য সার্বক্ষণিক ব্যাংকিং লেনদেন চালু এবং অর্থ পাঠানোর খরচ সাশ্রয়ী হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেইসাথে রেমিট্যান্সের আসা-যাওয়ার ভারসাম্য রক্ষায় বিদেশিদের বদলে দেশীয় কর্মীদের নিয়োগ দিতে হবে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে। সেইসাথে বৈধপথে রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে বাড়াতে হবে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের ব্যবহার। এসব নিশ্চিত করতে পারলেই রেমিট্যান্সের পালে লাগবে উচ্চগতির হাওয়া।