রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সই হয়েছিল, যার মধ্যস্থতা করেছিলো চীন। তখন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর তথা নেতৃত্বে অং সান সু চি। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা হবে। ২০১৮ সালেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। বারবার নেয়া উদ্যোগ ভেস্তে গেছে বহুবিধ কারণে। ২০১৯ সালের আগস্টে চীনের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আরেকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় রোহিঙ্গারা যেতে চায়নি। এর মধ্যেই ২০২১ সালে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী। জান্তা সরকারের সময়েও প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা ছিলো। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে জান্তার উত্তপ্ত অবস্থাতেও ২০২৩ সালের মার্চ মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তালিকা যাচাই-বাছাই করতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে আসে। সে বছরই ১৮ এপ্রিল ফের চীনের মধ্যস্থতায় দেশটির কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের ত্রিপাক্ষিক একটি বৈঠক হয়। এর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ২০ জনের একটি প্রতিনিধি দলকে মিয়ানমারে পরিদর্শনে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এমনকি বছরের শেষ নাগাদ ১১০০ রোহিঙ্গা ফেরত যাবার দিনক্ষণও চূড়ান্ত হয়। তৈরি হয় ট্রানজিট ক্যাম্পও। কিন্তু থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সর অপারেশন ওয়ান জিরো টু সেভেন শুরু হলে আটকে যায় সব উদ্যোগ।
সাম্প্রতিক একটি খবর, যেটি এবার সাম্প্রতিক একটি খবর দেখা যাক। প্রধান উপদেষ্টার বিমসটেক সফরে বিভিন্ন অর্জনের মধ্যে অন্যতম বলে যে খবরটি বিবেচিত হচ্ছে তা হলো, মিয়ানমার জানিয়েছে তালিকাভুক্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার যোগ্য বলে নিশ্চিত করেছে দেশটি। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানকে এ কথা জানিয়েছেন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে শুক্রবার বৈঠক করেন তাঁরা। শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজের এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়। এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের জান্তা সরকারের তরফে এ ধরনের তথ্য জানানো হলো। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকা দিয়েছিলো বাংলাদেশ। সেখান থেকেই ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শনাক্ত করেছে নেপিদো। আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ও ছবি চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে। এর বাইরে আরও সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই জরুরি ভিত্তিতে করবে বলেও আশ্বস্ত করেছে জান্তা সরকার। মিয়ানমারের নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গিকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে অগ্রগতি মানছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
কিন্তু যে বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমার জান্তা এই প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেখানে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জান্তাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যের সরকার বা এনইউজি। ওই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্য জিন মার অং বলেছেন, ব্যাংকক সম্মেলনে জান্তার অংশগ্রহণ বিমসটেক সনদের লঙ্ঘন। কারণ তারা মিয়ানমারের জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়। এই খবর জানিয়েছে ইরাবতি।
আবার যে রাখাইনে রোহিঙ্গারা ফেরত যাবেন সেটি কার দখলে। প্রতিশ্রুতি দেয়া জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণতো সেই অঞ্চলে। ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর, মিয়ানমারের জান্তা সরকার তথা এসএসি বা স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল তথা টাটমাডোর বিরুদ্ধে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অপারেশন ওয়ান জিরো টু সেভেন শুরু হওয়ার পর থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টি এবং চিন রাজ্যের পালেতোয়া দখল করে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাস মূলত মংডু, বুথিডাং, রাথিডং ও চ্যাকফু টাউনশিপে। কিছু আছে সিত্তওয়েতেও। সিত্তওয়ে ছাড়া সবগুলোই আরাকার আর্মির দখলে। সিত্তওয়ে পুরোপুরি দখল না হলেও ঘিরে রেখেছে বাহিনীটি। এ বিষয়ে একবার আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আরাকান আর্মির মুখপাত্র থাইন তু খা জানিয়েছিলেন, যেহেতু সিত্তওয়ে বন্দরটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আছে তাই সেসব যাতে ধ্বংস না হয় তাই কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন তারা। তবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত প্রায় সবটাই আরাকান আর্মির দখলে। তাহলে জান্তা সরকার তাদের ফেরত নিয়ে কোথায় রাখবে।
সরকার এরই মধ্যে একাধিকবার বলেছে যে আরাকান আর্মির সাথেও আলোচনা চলছে।এই আলোচনা কি শুধু ঢাকা করছে, নাকি নেপিদোও আছে সেই টেবিলে। কিন্তু নন স্টেট অ্যাক্টর আরাকান আর্মির সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ঠিক কি ফরম্যাটে এগোবে ঢাকা, সেটাই এখন বোধহয় বড় প্রশ্ন। মনে করা যেতে পারে সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরে গিয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে তিনি সংকট সমাধানের জন্য আরাকান আর্মির সাথে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকাকে। এমনকি মানবিক করিডোরের পরামর্শও দিয়েছেন। ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নিত্য প্রয়োজনী দ্রব্য সরবরাহে এমন মানবিক করিডোরের প্রয়োজনীয়তা বিমসেটক সামিটে পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টাও। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে কাউন্টার পার্ট কে হবে?
অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি রাখাইনের দখলে থাকা আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গিও নজর এড়ালে চলবে না। ২০২২ সাল পর্যন্ত আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের “রোহিঙ্গা” হিসাবেই মিয়ানমারের নাগরিক মানতো। ধর্ম নয়, জন্মস্থানই ছিলো বিবেচ্য। কিন্তু লক্ষণীয় হলো, ২০২৩ সালে অপারেশন ওয়ান জিরো টু সেভেন শুরুর পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির খানিক পরিবর্তন হয়েছে। এখন তারা বরং “রোহিঙ্গা” শব্দেই আপত্তি জানায়। সেক্ষেত্রে আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসাবে উল্লেখ করতে স্বচ্ছন্দ তারা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার সেনাবাহনীর দ্বারা নির্যাতিত হলেও, বছর খানেক আগে থেকে তাদের একটা অংশ আরাকান আর্মির বিপক্ষে গিয়ে টাটমাডোর পক্ষে যুদ্ধ করছে বলে দাবি করে তারা আরাকান আর্মি। এমনকি এতে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা, আরএসওর অংশগ্রহণ নিয়েও সন্দেহ আছে তাদের। ঠিক এ কারণেই সম্ভবত রোহিঙ্গাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান বদলেছে আরাকান আর্মি। গত কয়েক মাসে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে তারা আরাকান আর্মির নির্যাতনের অভিযোগও তুলেছেন। ফলে বাস্তবতা হলো, রাখাইন স্থিতিশীল হওয়ার আগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সুদূর পরাহত। কারণ এই প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছা, নিরাপত ও মর্যাদাসম্পন্ন। আগে ছিলো জান্তার ভয়, এখন আরাকান আর্মির আতঙ্ক নিয়ে রোহিঙ্গারা কতটা ফিরতে চাইবেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ রোহিঙ্গারা ফিরতে চান, তাদের প্লেস অব অরিজিন অর্থাৎ নিজ ভূমিতে।কে ফেরাবে তাদের নিজ ভূমিতে? জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি, এনইউজি নাকি জাতিসংঘ?
নাহিদ হোসেন
সাংবাদিক
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: যদি…কিন্তু…তবে
