মাত্র দেড় বছর আগেই যে দেশটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে দেউলিয়া প্রায় অবস্থা, বর্তমানে সে দেশটিই নিয়েছে কিছু পদক্ষেপ, অনুসরণ করেছে কিছু নীতি। যার ফলস্বরূপ সম্ভব হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতি।
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। আজ থেকে দেড় বছর আগে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়। মূলত দুর্বল সরকার ব্যবস্থা, অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি, করোনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিস্থিতিই এই বিপর্যয়ের মূল কারণ।
শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে। তবে কখনোই এমন চরম সংকটে পড়তে হয়নি দেশটিকে। তবে হঠাৎ করেই বৈদেশিক ঋণের ভরে জর্জরিত হয়ে পড়েছে দেশটি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ।
শুধু খাদ্য খাতেই নয় বরং পরিবর্তন এসেছে শিক্ষাখাতেও। কাগজের অভাবে দেশটির স্কুল কলেজের পরীক্ষা বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। কারণ বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি করার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ দেশটির নেই। জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দেওয়ায় পেট্রোল পাম্প গুলোতে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়। পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ায় শ্রীলঙ্কান সরকার মোতায়েন করেছে সেনাবাহিনীকে।
ইরানের কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করলেও সেটির মূল্য পরিশোধ করতে সক্ষম হয়নি শ্রীলঙ্কা। প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণের ভারে জর্জরিত এই দেশ। যার ফলে এখন প্রতিমাসে ৫ মিলিয়ন ডলারের চা ইরানে রপ্তানি করে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর নীতি:
বিগত দেড় বছর অর্থনৈতিক মন্দার সাথে পাল্লা দিয়ে অবশেষে, ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস পাওয়া গেল। মূলত সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঐক্যবদ্ধভাবে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে।
প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহের (অর্থনীতির অধ্যাপক, কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষ্যমতে, মূলত রেমিট্যান্স ও পর্যটন খাতের মাধ্যমেই দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার সরকার রাজস্ব বাড়িয়ে ব্যয় কমিয়েছে। এর পাশাপাশি করজাল বিস্তৃত করেছে সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করার মাধ্যমে। আইএমএফ এর পাশাপাশি বিভিন্ন ঋণদাতা দেশের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সরকার রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। গত বছর শ্রীলঙ্কার বেশকিছু দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিককে বিদেশ পাঠানোর ফলে রেমিটেন্সের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।
পর্যটন খাতেও উন্নতি হয়েছে শ্রীলঙ্কার। এই খাতে পূর্বের তুলনায় আয়ের পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি এই ১ বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোতেও শ্রীলঙ্কার বেশ অগ্রগতি লক্ষণীয়।
পদক্ষেপ বাস্তবায়ন:
- চলতি বছরের মার্চ মাসে আইএমএফ এর সাথে “বেইল আউট প্যাকেজ” নামের চুক্তি অনুমোদিত হয় যা প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার।
- প্রায় ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করে সরকার। এর পাশাপাশি চেষ্টা করে দ্রব্যমূল্য ও বিদ্যুৎ খরচের দাম কমানোর।
- ২০২২ সালে প্রায় ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষকে কাজের জন্য বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে ডাক্তার, প্যারামেডিকেল, আইটি প্রফেশনাল।
- ২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসে শ্রীলঙ্কার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। যার মধ্যে চা ও রাবার রপ্তানি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে।
- শ্রীলঙ্কার চলমান প্রকল্পগুলো থেকে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ডলার জরুরি প্রয়োজনের খাতে সরিয়ে নেয়। ফলে মানুষ সহজেই ঔষুধ, লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস এলপিজি এর মত পণ্যগুলো পেয়েছে।
- বিশ্বব্যাংক থেকে বাজেট সহায়তার জন্য শ্রীলঙ্কার সরকারকে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ:
১. অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প
বিগত ১৫ বছরে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা নির্মাণ সহ আরো বিভিন্ন রকমের প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা। এই কাজের জন্য ব্যয় করতে হবে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার এবং সময় লাগবে প্রায় ২৫ বছর। এসব প্রকল্পের পেছনে মূল চেষ্টা হচ্ছে হংকং, দুবাই এবং সিঙ্গাপুর থেকে এগিয়ে থাকা। চীনের সাথে একত্রিত হয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হলে বিপুল পরিমাণ ঋণের ভারে জড়িয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা। যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
২. অতিরিক্ত ঋণের ভারে জর্জরিত
গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলঙ্কার সরকার দেশী বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে একের পর এক ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের অন্যতম উৎস হলো সার্বভৌম বন্ড। যে কোনো ধরনের আর্থিক প্রয়োজনেই ২০০৭ সাল থেকেই দেশটির সরকার সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে আসছে। যখনি আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হয়েছিল, প্রতিবারই এই বন্ড ইস্যু করেছে সরকার। তবে পরবর্তীতে কীভাবে এই অর্থ পরিশোধ করা হবে তা নিয়ে কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না এই দেশের সরকারের।
৩. ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা
শ্রীলঙ্কার ঋণ পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড এবং দেশীয় উৎস। সব মিলিয়ে গত বছর দেশটির সরকারকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কা মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধে করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোতাবেক, গত ৩ বছরে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড বাবদ প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
৪. পর্যটন খাতের বিপর্যয়
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে দেশটির পর্যটন খাতে দেখা যায় বিপুল বিপর্যয়। প্রায় ২ বছর এই খাতের সকল কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে করোনার আগে চীন থেকে অনেক পর্যটক আসতো শ্রীলঙ্কা ঘুরতে। কিন্তু চীনের সরকারের কঠোর বিধি নিষেধ থাকার কারণে পর্যটকরা যেতে পারেনি শ্রীলঙ্কাতে।
তবে এই সংকট কাটিয়ে উঠছে শ্রীলঙ্কা। জমে উঠেছে দেশটির অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস পর্যটন খাত। চালিয়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর – অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা। যার মেয়াদকাল ছিল ১ বছর। চলতি বছরের আগস্ট মাসে ৪ কিস্তিতে নেওয়া সেই ঋণের ৫০ মিলিয়ন বাংলাদেশকে ফেরত দিয়েছে।
৫. অর্গানিক চাষে বিপর্যয়
২০১৯ সালের শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে চালু করেন অর্গানিক কৃষি ব্যবস্থা। ফলে নিষিদ্ধ হয়ে যায় কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যায় সার আমদানি। ফলে শ্রীলঙ্কায় চালের উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায়। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শ্রীলঙ্কার সরকার আমদানি করে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। শুধু তাই নয়, বরং চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে চরম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে দেশটিকে। কৃষকদের ক্ষতি পূরণের জন্য সরকার প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দেয়। মূলত অর্গানিক কৃষি নিয়ে যথাযথ গবেষণার ঘাটতির কারণেই দেশটির খাদ্য খাতে এমন বিপর্যয় দেখা দেয়।
বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ:
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উৎস সমন্বিত করে শ্রীলঙ্কার এখন মত ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আবার কোথাও কোথাও বলা হয়েছে এই ঋণের পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৭ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কান সরকারকে ২৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধ করতে হবে। পরিশোধকৃত ঋণের মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি শোধ করতে হবে চীন, জাপান ও ভারতকে।
দেশটির সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঋণ পুনর্বিন্যাসের। সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থার সাথে সফলভাবে আলোচনা সম্ভব হলে ঋণ কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে। পর্যটন ও রেমিট্যান্স এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও এখনো শুরু হয়নি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কার্যক্রম। এটি শুরু হলেই জন্য যাবে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির কতটা উন্নয়ন সম্ভব হবে ভবিষ্যতে।