পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন বিষয়টি মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের প্রেক্ষিতে জরুরি হয়ে পড়েছিলো । সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধন এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করায় সংবিধান সংশোধন সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে বর্তায়। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী আগেই বাতিল হয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী অর্থাৎ সংবিধানের ৫৮(ক) থেকে ৫৮ (৫) পর্যন্ত সংযোজন মূলনীতি গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করা হয়েছে। রায়ে তিনটি বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। যেমন- প্রথমত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা, দ্বিতীয়ত জন স্বার্থে আরো দুটি নির্বাচন সংসদ ইচ্ছে করলে করতে পারেন এবং তৃতীয়ত বিচারপতিদের সংশ্লিষ্ট না করা। রায়টি বিবেচনায় নিয়ে দেখা যাবে প্রচলিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেহেতু বাতিল হয়েছে সেহেতু আরো দুটি নির্বাচন করতে হলে তেমন ব্যবস্থাই প্রয়োজন যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না এবং যেখানে অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারপতি থাকবেন না। অর্থাৎ অনির্বাচিত কোন ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে পারবেন না।
পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী একেবারে বাতিল ঘোষিত হয়। সরকারের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বিধায় সরকার এসব ব্যবস্থা একাই নিতে পারবেন। কিন্তু এমন প্রশ্ন যে কেউই করতে পারেন কেন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা বিরোধীদলের দাবি পূরণে এগিয়ে আসবেন? বিগত দিনে আওয়ামী লীগের জোর আন্দোলনে বিচলিত হয়ে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন সৃষ্টি করেছিল তা কি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে করেছিল? জনগণ কি বিএনপিকে এমন আইন করতে ভোট দিয়েছিল? বিএনপি যদি এমন একটি আইন পাশ না করে সোজাসাপ্টা পদত্যাগ করতো তাহলে কি অন্যায় অপরাধ হতো। প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন বিএনপি সরকার ভুল করেছিল। কারণ গণতন্ত্র যোগ্য ব্যক্তিকে শাসন করতে বাধ্য করতে পারে না। এটাই গণতন্ত্রের ত্রুটি আওয়ামী লীগ কি আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় সংশোধন করে, আলোচনা করে কিংবা অন্যসব রাজনৈতিক দলের সম্মতিক্রমে পাশ করতে বাধ্য । জনগণ কি আওয়ামী লীগ সরকারকে এমন ম্যান্ডেট দিয়েছেন। বিএনপি যা করেছেন আওয়ামী লীগ সে পথে নাও যেতে পারে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে একবাক্যে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তন বলা যেতে পারে। তবে ৫ম, ৭ম ও ১৩তম সংশোধনীর কারণে যেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে তার বৈধতা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব অনুসারে ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের ১৫ জন সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এ কমিটিতে তাদের কোন সদস্য দেন নাই। ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ঐ কমিটি ১১ মাস ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সামাজিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং একটি রিপোর্ট তৈরি করে তা ৮ জুন ২০১১ তারিখে সংসদে পেশ করেন। ঐ রিপোর্টের ভিত্তিতে আইনমন্ত্রী একটি বিল প্রণয়ন করে ২৫ জুন সংসদে উত্থাপন এবং ৩০ জুন ২০১১ আইন ও সংসদ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি ঐ বিলটি সুপারিশ করে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন ২০১১ শিরোনামে জাতীয় সংসদে দাখিল করেন। ৩০ জুন ২০১১ তারিখে বিলটি ২৯১-০ বিভক্তি ভোটে গৃহীত হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট ঐ সময়ে সংসদ বর্জন করে আসছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:-
১। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৪ মূলনীতির পুনঃবহাল।
২। সংবিধানের প্রারম্ভে প্রস্তাবনার উপরে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকে।
৩। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় নাই।
৪। বাংলাদেশের জনগণের পরিচিতি জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশি করা হয়।
৫। জাতির পিতার প্রতিকৃতি সর্বত্র প্রদর্শনের আইন করা হয়।
৬। ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) বাতিল ।
৭। সংসদে মহিলা সংরক্ষিত আসন ৪৫ থেকে ৫০ এ উন্নীত হয়। পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল থাকে।
৮ । ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যোগসাজশকারী এবং ঐ অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিদের ভোটদান ও নির্বাচন করার অধিকার যা পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা বারিত ছিলো তা পুনরায় বহাল করা হয়।
৯। ১৯৭২ সালের ৭২ অনুচ্ছেদের পুনঃবহাল এবং বাধা শিথিল।
১০। নির্বাচন কমিশনের সদস্যসংখ্যা সর্বমোট ৫ জন করা হয়। আগে ৩ জন ছিলো।
১১ । সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয় ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙ্গে গেলে, ভেঙ্গে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে যে কোনোদিন এবং অন্য কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার ৯০ দিন পূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সদস্যগণ সপদে বহাল থাকবেন’।
১২। জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে তা ১২০ দিনের অধিক স্থায়ী হবে না। তবে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়া অবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে অথবা উক্ত ১২০ দিনের মধ্যে সংসদ ভেঙ্গে গেলে পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের ৩০ দিনের মধ্যে ঘোষণাটি সংসদে অনুমোদিত হতে হবে। নতুবা তা অকার্যকর হবে।
১৩। সংবিধানের নূতন ৭ক অনুচ্ছেদ সংযোজন। এতে বলা হয় ‘কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় এ সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ রদ, বাতিল বা স্থগিত করে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে বা ষড়যন্ত্র করে তাহলে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে সর্বোচ্চ দণ্ডে (মৃত্যুদণ্ড দণ্ডিত হবেন।
১৪ । সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ দেবেন।
১৫। সংবিধান সংশোধনের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোট বাতিল।
১৬। নূতন ৭খ অনুচ্ছেদ সংযোজন করে প্রস্তাবনা, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের সকল অনুচেছদ সংশোধনের অযোগ্য করা হয়।
১৭। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে ৫ম ও ৭ম সংশোধনের উদ্দেশ্যে চতুর্থ তফশিল যেমন সামরিক ফরমান ও আইন অন্তর্ভুক্ত ছিলো তা বাতিল করা হয়।
১৮। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চ এর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ক্রান্তিকাল ও অস্থায়ী বিধানাবলি সংবিধানে সংযোজন। পঞ্চদশ সংশোধনের কারণে সংবিধানের প্রস্তাবনা, ২ক অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন, ৪ক প্রতিস্থাপন, নূতন ৭ক ও ৭খ সন্নিবেশ, অনুচ্ছেদ ৮ সংশোধন, অনুচ্ছেদ ৯, ১০, ১২প্রতিস্থাপন, অনুচ্ছেদ ১৮ক সন্নিবেশ, অনুচ্ছেদ ১৯ সংশোধন, ২৩ক সন্নিবেশ, অনুচ্ছেদ ২৫ সংশোধন, ৩৮ প্রতিস্থাপন, ৪২ সংশোধন, ৪৪ প্রতিস্থাপন, ৪৭ সংশোধন, অনুচ্ছেদ ৫৮ক বাতিল, ২ক বিলুপ্ত, ৬১ প্রতিস্থাপন, ৬৫, ৬৬ সংশোধন, ৭০ প্রতিস্থাপন, অনুচ্ছেদ ৭২, ৮০, ৮২, ৯৩ সংশোধন, ৯৫, ৯৬, ৯৯, ১০০, ১০১, ১০২, ১১৬, ১৪২, ১৪৫ক, ১৫০ প্রতিস্থাপন ও অনুচ্ছেদ ৯৮, ১০৩, ১০৭, ১১৭, ১১৮, ১২৩, ১২৫, ১৪১ক, ১৪৭ ও ১৫২ সংশোধন করা হয়।
তাছাড়া সংবিধানের প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ তফসিলেও সংশোধন করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল হয়। বিরোধীদল ঐ ব্যবস্থা ফিরে পেতে চায়। কিন্তু এটির কোন রূপরেখা তারা উত্থাপন করতে সক্ষম হয় নাই ।