মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের জন্মলগ্ন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে অনুমোদিত একটি খসড়া শাসনতন্ত্র থেকে। অর্থাৎ ঐ দিন থেকে আমাদের শাসনতন্ত্র  যাত্রা শুরু করে যদিও কার্যকরের তারিখ ছিলো ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। যে গণপরিষদ এটি পাশ বা অনুমোদন কিংবা সূচনা করে তারও একটি জন্ম ইতিহাস আছে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কুষ্টিয়ার একটি জঙ্গল ( আম বাগান) মুজিবনগর ঘোষণা করে অধিবেশনে বসে ১৯৭০ এর ভোটে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ। এনারা তখন এম. এন. এ এবং এম. সি. এ উপাধিতে ভূষিত হতেন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সারে ১০ এপ্রিল বসে প্রথম অধিবেশন ঢাকায় সংসদ ভবনে। এখানে সভাপতিত্ব করেন মৌলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীস। ১০ এপ্রিল ও ১১ এপ্রিল দুটি বৈঠকের মধ্যদিয়ে শেষ হয় প্রথম অধিবেশন। এর পরে ১২ অক্টোবর থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ অনুষ্ঠিত হয় সর্বমোট ২১টি বৈঠক। এসব বৈঠকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি ছিলো জাতিকে একটি শাসনতন্ত্র বা সংবিধান উপহার দেয়া। 

 

এলক্ষে ১১ এপ্রিল ১৯৭২ সালেই গঠিত হয়েছিলো ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি যার সভাপতি ছিলেন ড. কামাল হোসেন। এ কমিটি ৬ মাস ২৮ দিনের ৭২টি কার্যদিবসে ৭২টি সংশোধনী প্রস্তাব বিবেচনা করে ৭২ পৃষ্ঠায় হাতের লেখা একটি দলিল সংসদের ১৭ তম অধিবেশনে উপস্থাপন করেন যা গৃহীত হয় ৪ নভেম্বর ১৯৭২ আর কার্যকরের তারিখ ঘোষিত হয় ১৪৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। একইসাথে বঙ্গবন্ধু ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে তার সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানান। ঐ তাঁতের লেখা সংবিধানটি সংরক্ষিত হচ্ছে জাতীয় যাদুঘরে। এটিই ১৯৭২ সালে সর্বজন গৃহীত ব্যাপক সমাদৃত জাতীয় দলিল যা বার বার আঘাতে আঘাতে কেটে ছিড়ে আজকের অবস্থায় পৌঁছেচে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দুটি সামরিক শাসন ও বৈধকরণ প্রচেষ্টা ৭২ এর সংবিধানকে সমূলে বদলে ফেলে। তারও পূর্বে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে তৈরি এ সংবিধান নিজেই বদলে ফেলার মত ভুল সিদ্ধান্ত চতুর্থ সংশোধনী জাতিকে হতবাক করে। সংবিধানের অতি সহজ সরল সংজ্ঞা হচ্ছে এমনসব নীতিমালা যা রাষ্ট্রের জনগণ নিজেই পছন্দ করে বেছে নেয়। আর এগুলো এত শক্তিশালী যে দেশের অন্যসব আইন যদি এর সাংঘর্ষিক হয় তবে সবগুলিই বাতিল হয়ে যাবে। কে সি হুয়ার একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি বলেছেন সংবিধানের আইনগুলো রাষ্ট্রের সরকারকে দমিয়ে রাখে, স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী হতে দেয় না।। সরকার গঠনকারী ব্যক্তিরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে যদি লাগাম ছাড়া ঘোড়া হয়ে যায়, যদি ধরাকে সরা জ্ঞান করে কিংবা হাতির পাঁচ পা দেখতে শুরু করে তাহলে সংবিধানের বিধানগুলো জোঁকের মুখে লবণের মত কাজ করে। আর এ কারণে সংবিধান তার দেখাশুনা করার একমাত্র গার্ডিয়ান ঠিক করেছে সুপ্রিম কোর্টকে। অর্থাৎ কোন আইন কী অর্থ কী উদ্দেশ্য তা ব্যথা করার একমাত্র মুখপাত্র সুপ্রিম কোর্ট। এমনকি সরকার যদি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের চাকুরি, বেতন, অপসারণ, অবসর এসব নিয়ে বিধান তৈরি করে সেটারও ব্যাখ্যা দেবে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধান বা শাসনতন্ত্র আদতে আইন নয় আইনের মা জননী। আমরা যেম মাতৃগর্ভে ভ্রূণ হয়ে জন্ম নেই প্রাণ পাই তেমনি আমাদের দেশের সবরকম আইন জন্ম নেয় সংবিধান বা শাসনতন্ত্র থেকে। কাজেই সংবিধান কত বড় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে যারা সংবিধান সৃষ্টি করে অর্থাৎ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের দ্বায়িত্ব কত বেশী এবং বড় তাও অনুমান করা যায়। আর কদিকে যারা এই সংবিধানকে কাটাকাটি করে নিজেদের সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করে অবৈধ কাজ বৈধ করে তারা কত বড় নির্বোধ এবং মতিচ্ছন্ন আর লোভী তাও জনগণ বুঝতে পারে।

 

অতি সম্প্রতি বর্তমান সরকার সংবিধানের ১৬তম সংশোধনা চূড়ান্ত করেছেন। সংবিধান সংশোধন করা পাপ নয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ এর পথ ও পদ্ধতি বলে দিয়েছে। সংবিধানের ৯৫ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ মূলত আমাদের বিচার বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণের বিধান দিয়ে রেখেছে। আগেই বলেছি সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানে মুখ ও ভাষা। সরকার যে আইনের বিধান তৈরি করুক সংবিধান তার ভাষায় তার মুখদিয়ে হা বা না বলবে। 

- Advertisement -

 

১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নং উপ-অনুচ্ছেদ হলো “প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতি সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারক নিয়োগদান করিবেন।

 

অনুচ্ছেদ ৯৬(১) হলো “কোন বিচারক বাষট্টি বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।” কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ফলে ১৯৭৫ সালে প্রণীত ২ আইনের ১৩ ধারা বলে দিল অন্য বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শের প্রয়োজন নাই। ১৯৭৮ সালের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান সৃষ্টি হলো যার সদস্য প্রধান বিচারপতি ও অন্য দুইজন প্রবীণ বিচারক যারা বিচারক নিয়োগের পরামর্শ দেবেন। আর বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬২ থেকে ৬৫ এবং ২০০৪সালে ৬৫ থেকে৬৭ পর্যন্ত বেড়ে গেল। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে ২০১১ সালে ১৪ নং আইনে ৯৫ নং অনুচ্ছেদ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে ফিরে গেল। 

 

৯৬ নং অনুচ্ছেদে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল শুধু মাত্র কাউন্সিল নামে অবহিত হলো। এরই মধ্যে যেহেতু সংবিধানের ৪র্থ (পূর্বেই সংশোধিত) ৫ম, ৭ম ও ১৩ তম সংশোধনী আদালত নিজেই বাতিল করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি মাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন হয়ে প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসনব্যবস্থাার প্রচলন হয়েছে সেহেতু ৯৫ ও ৯৬ অনুচ্ছেদের বিচারপতিগণের নিয়োগ অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদ তার নিজের কাছেই রাখতে চায়। এলক্ষে জাতীয় সংসদ সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী আনতে চায়। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে মন্ত্রীপরিষদ একটি বিলও অনুমোদন দিয়েছেন যা সংসদে পাশ হয়। অন্যদিকে কতিপয় টিভি, এনাদের কেউ কেউ টিভি টকশো গুলোতে গোটা পরিবেশটাকে টক করে ফেলেছেন। কোন কোন অতি উৎসাহী টকশো প্রোত জয়যুক্ত হয়েছে’ এই ভয়ে ভীত হয়ে টিভি কেন্দ্রে ফোন করছেন। যথারীতি সংসদ সংবিধানের ষোলতম সংশোধনী পাশ করেছেন এবং সুপ্রিম কোর্ট তা দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ম পদ্ধতির অনুসরণে বাতিল করেছেন। সরকারও আইনি প্রক্রিয়ার অনুসরণে আপিল করেছেন। এযাবৎ গোটা বিষয়টি আদালত সৃষ্ট এবং সমাধানও আদলতের এখতিয়ারে। কিন্তু এখানেও ঘটেছে অবৈধ হস্তক্ষেপ। বিষয়টি এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, বোদ্ধামহল মনে করেন এবারে সামরিক হস্তক্ষেপ নয় সংবিধান বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে।

- Advertisement -

কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

  • সাবস্ক্রাইব করুন তথ্যবহুল সত্য খবরের জন্য 

    You are our valued subscriber. We send weekly newsletter. NO SPAM

আরও পড়ুন

ব্যক্তিগত আয়কর জমা দিতে কি কি কাগজপত্র লাগবে?

একজন করদাতা আলোচ্য করবর্ষে আয়কর রিটার্ন পূরণ এবং রিটার্নের...

আয়কর জমা দিতে কি কি তথ্য জমা দিতে হয়?

যখন একজন করদাতা আয়কর রিটার্ন জমা দিবেন তখন বিভিন্ন...

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী

পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন বিষয়টি মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের...

সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী

সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন...

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন...

সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী

সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীকে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাবর্তন বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ...