বাংলাদেশের সংবিধান বলতে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে অনুমোদিত খসড়া শাসনতন্ত্রকে ধরা হয়। অর্থাৎ ঐদিন থেকেই যাত্রা শুরু যদিও কার্যকরের তারিখ রাখা হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। এরও পূর্বে এ সংবিধানটির রয়েছে একটি ধারাবাহিক পথচলা।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর আমবাগানে ১৯৭০ এ নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ গণপরিষদ। স্বাধীন বাংলাদেশে এ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সনের ১০ এপ্রিল। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মৌলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। ১০ এপ্রিল ও ১১ এপ্রিল দুটি বৈঠকের মধ্যদিয়ে প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় ১২ অক্টোবর আর শেষ হয় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২। বৈঠক হয় ১৯টি। দুটি অধিবেশনের ২১টি বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করা হয় তা হলো জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এ লক্ষ্যে ১১ এপ্রিল ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন ড. কামাল হোসেন। অন্য সদস্যরা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমাদ, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান, এম আব্দুর রহিম, আব্দুর রউফ, মোঃ লুৎফর রহমান, আব্দুল মমিন তালুকদার, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মোহাম্মদ বরতুল্লাহ, আমীর উল ইসলাম, বাদল রশীদ (বার, এটল) খন্দকার আব্দুল হাফিজ, মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, শওকত আলী খান, মোঃ হুমায়ুন খালিদ, আছাদুজ্জামান খান, এ.কে. মোশাররফ হোসেন আখন্দ, আব্দুল মমিন, শামসুদ্দিন মোল্লা, শেখ আব্দুর রহমান, ফকির সাহাবুদ্দিন আহমদ, আব্দুল মুনতাকীম চৌধুরী, অধ্যাপক খুরশেদ আলম, সিরাজুল হক অ্যাডভোকেট, দেওয়ান আবুল আব্বাছ, হাফেজ হাবিবুর রহমান, মোঃ আব্দুর রশীদ, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ খালেদ, বেগম রাজিয়া বানু ও ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল।
সংবিধান রচনায় টেকনিক্যাল বিভিন্ন বিষয়ে যারা জড়িত ছিলেন তারা হলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, হাশেম খান, এ.কে.এম আব্দুল রউফ, জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল বারক আলভি ও সৈয়দ শাহ আবু শফি 1 সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ১৭ এপ্রিল ১৯৭২ সালে প্রথমবার বৈঠকে বসেন এবং ৬ মাস ২৮ দিনে ৭২ কার্যদিবসে, ৭২টি সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব বিবেচনা করে ৭২ পৃষ্ঠায় একটি হাতে লেখা সংবিধান গণপরিষদে ১৭তম অধিবেশনে দাখিল করেন যা গৃহীত হয় ৪ নভেম্বর ১৯৭২ এবং কার্যকরের তারিখ ঘোষিত হয় ১৬ ডিসেম্বর। এর পূর্বদিন ১৫ ডিসেম্বর রাত ১০.৫০ ঘটিকা বঙ্গবন্ধু গণপরিষদ ভেঙ্গে দেন এবং নতুন নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানান।
১৯৪৭ সালের পরে ভারতেও এত দ্রুত সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব হয় নাই। অন্যদিকে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে যে সংবিধান তৈরি ও অনুমোদন দেয়া হয় তা ১৯৫৮ সালেই বাতিল করে দেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা। এর মাত্র ২০ দিন পরে আর এক জেনারেল লৌহমানব আইয়ুব খান ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সামরিক শাসন চালু করেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে সবার আগে এ সংবিধানের উপর আঘাত আসতে থাকে বারবার। যে যার মত সুবিধা এ সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে যা আজও চলমান। কিন্তু কেন এ আঘাত? সংবিধান কার পথের কাঁটা? সংবিধান সমুন্নত চলমান থাকলে কারা অসুবিধা অনুভব করেন- কাদের অপছন্দ? এসব প্রশ্নের উত্তর সংবিধান তার নিজের কাছেই রেখেছে। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক খুব সহজ করেই বলেছেন সংবিধান হচ্ছে এমন সব বিধান যা রাষ্ট্রের নাগরিকরা নিজেরাই বেছে নিয়েছেন। আর এসব বিধি-বিধানই হচ্ছে সর্বোচ্চ। দেশের অন্যসব আইন যদি এর সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে সবগুলোই বাতিল হয়ে যাবে।
কেসি হুইয়ার একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি বলেছেন সংবিধানের আইনগুলো রাষ্ট্রের সরকারকে শাসন করে, দমিয়ে রাখে। স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী হতে দেয় না। সরকার গঠনকারী ব্যক্তিরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে যদি লাগামছাড়া হয়ে যায়, যদি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকে, কিংবা যদি হাতির পাঁচ পা দেখতে শুরু করে তাহলে সংবিধানের আইনগুলো জোঁকের মুখে লবণের মত কাজ করতে শুরু করে। আর এ কারণে সংবিধান তার দেখাশুনা করার একমাত্র দায়িত্ব দিয়েছে দেশের সুপ্রিম কোর্টকে। অর্থাৎ গার্ডিয়ান বানিয়েছে। সংবিধানের কোন আইনের কি অর্থ তা ব্যাখ্যা করার ভার সুপ্রিম কোর্টকেই দিয়েছে। অন্য কেউ নয়। অর্থাৎ সরকার বা কোন নাগরিক কেউই সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়। সংবিধান বা শাসনতন্ত্র বা নীতিমালা কিন্তু আইন নয়, আইনের জননী। আমরা যেমন মাতৃগর্ভে ভ্রূণ হয়ে জন্ম নেই, প্রাণ পাই তেমনি আমাদের দেশের সবরকম আইনই জন্মগ্রহণ করে ঐ সংবিধান বা শাসনতন্ত্র থেকে। এর থেকেই অনুমান করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় সংবিধান কত বড়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধানের হাতে লেখা যে খসড়াটি অনুমোদিত হয় তাতে স্বাক্ষর করেন ৩৯৯ জন সদস্য। এই ৩৯৯ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের ভোটার জনগণ। অতএব সংবিধানটির সৃষ্টিকর্তা, জন্মদাতা পিতা হচ্ছে এদেশের জনগণ। সেই হাতে লেখা সংবিধানটি সংরক্ষণ করা হয় জাতীয় যাদুঘরে। এরকম একটি জাতীয় দলিল ছলে বলে কৌশলে যারা কেটে ছেঁটে ছোট বড় করতে যান তারা কতবড় নির্বোধ কিংবা অপরাধী তা সংবিধান নিজেই বর্ণনা করে। তাই বলে বাংলাদেশের সংবিধান অনমনীয় নয়। এটি লিখিত এবং সংশোধনযোগ্য।সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে এর সংশোধন পদ্ধতি বর্ণিত আছে ।জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার এক ফরমান বলে বিধান করেন যে, সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৫৬, ৮০ বা ৯১ (ক) সংশোধন করতে হলে গণভোট করতে হবে। এ ফরমানটি ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর অংশ হিসেবে সংসদে অনুমোদন করা হয়।
১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে গণভোটের জন্য অনুচ্ছেদ ৫৮, ৮০ এবং ৯১ (ক) বাদ দেয়া হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে গণভোটের বিধান বাদ দিয়ে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যায়। সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদসহ মৌলিক কাঠামো সংশোধনের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়। তবে সর্বক্ষেত্রেই দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের বিধান পূর্বের মত বলবৎ থাকে
বাংলাদেশের সংবিধানে এযাবৎ ১৬টি সংশোধনী গৃহীত হয়েছে যার ৬টি আওয়ামী লীগ ৬টি বিএনপি এবং ৪টি জাতীয় পার্টি শাসনামলে করা হয়। এ সমস্ত সংশোধনী কতটা জনস্বার্থে এবং কতটা ব্যক্তি ও দলীয় বিবেচনায় করা হয় এবং এগুলোর পটভূমি কী ছিল তা জনগণের জানা প্রয়োজন। কারণ এসব সংশোধনীতে জনগণের প্রতিনিধিরাই স্বাক্ষর করেছেন এবং সংশোধনীগুলোতে শেষ পর্যন্ত জনগণের স্বার্থের প্রতিফলন হয়েছে কি না তা বার বার খতিয়ে দেখায় বাধা নেই। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং চলছে। ইতিহাসের বিচারে প্রত্যেকের মূল্যায়ন তার কৃতকর্ম দেবে। এ কারণে ৪৫ বছরের বাংলাদেশে যে তিনটি রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করেছে তারও একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন সংবিধানের সংশোধনীগুলো থেকে আগামী প্রজন্মের নবীন নাগরিকরা বার বার বিচার বিশ্লেষণ করতে পারবেন।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি আরকাইভ অনলাইন-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।