‘সংলাপ’ শব্দের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় সম্+লাপ। এটা ব্যাকরণের কথা। কিন্তু এটিকে আরেকটু ঘুরিয়ে বলা যায় সম+আলাপ। মানে সমানভাবে আলাপ করা। অর্থাৎ যে আলাপ বা কপকথনটি একপাক্ষিক বয়ান নয়। বরং দুপক্ষই কথা বলবে। যুক্তিতর্ক তুলে ধরবে। সমভাবে যে যার অবস্থান ব্যক্ত করবে।
সংলাপের মূল শব্দ হচ্ছে আলাপ। তার সঙ্গে যুক্ত সং। কিন্তু এটি ‘সঙ’ হলে অর্থ বদলে যায়। তখন ‘সঙলাপ’ পরিণত হয় সঙালাপে। যে আলাপটি সঙ বা কৌতুকে পরিণত হয়। অতীতে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক সংলাপ বস্তুত এই সঙলাপেই রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল, সেটি শেষ পর্যন্ত আর সমআলাপ কিংবা একটি স্বাস্থ্যকর আলোচনা ও কথপকথনের পর্যায়ে না থেকে একধরনের সঙে রূপ নিয়েছে। হাস্যকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপের পরিণতি কী হবে—তা এখনও পরিষ্কার নয়। এখানে কতটুকু সমআলাপ হচ্ছে এই সেই আলাপের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত কী বেরিয়ে আসবে—তা এখনই বলা মুশকিল।
আলাপ ও সংলাপ অনেক সময় প্রলাপেও পরিণত হয়। অর্থাৎ কেউ যখন সংলাপ শেষে বেরিয়ে এসে অর্থহীন কথা বলতে থাকেন—সেগুলোকে প্রলাপ বলাই ভালো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রলাপ বকার ঘটনা শত শত। সেই প্রলাপ শুধু সংলাপেই নয়, খোদ জাতীয় সংসদেও হয়েছে। জনগণের ট্যাক্সের পয়সা খরচ করে। সেই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়; সংসদ যাতে ব্যক্তি স্তূতি আর প্রতিপক্ষের বিষোদ্গারের প্লাটফর্ম হিসেবে না থেকে সত্যিকারার্থেই জনগণের কল্যাণের ইস্যু নিয়ে আলাপের জায়গা হয়; যেন সেই আলাপগুলো যেন প্রলাপ না হয় এবং সংলাপগুলো যেন সঙালাপে রূপ না নেয়—এরকম নানাবিধ উদ্দেশ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ চলছে—যেটি শুরু হয়েছে গত ২০ মার্চ।
মূলত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ চূড়ান্ত করতেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম দিনে সংলাপে অংশ নেয় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)।
সংলাপের আগেই সবগুলো দলের কাছে চিঠি দিয়ে কমিশনের সুপারিশগুলোর ওপর মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। এমনকি দলের নিবন্ধন না থাকলেও জামায়াতে ইসলামির কাছেও কমিশন মতামত চেয়েছে এবং তারা ২০ মার্চ কমিশনের কাছে লিখিত সুপারিশ দিয়েছে—যেখানে জামায়াত জানিয়েছে যে তারা সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের প্রয়োজন দেখছে না। এর বাইরে নির্বাচনি ব্যবস্থা, প্রশাসনসহ নানা বিষয়ে জামায়াত তাদের মতামত তুলে ধরেছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে অন্তর্বর্তী সরকার এ পর্যন্ত ১১টি সংস্কার কমিশন করেছে। এরপর গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন—যার সভাপতি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই কমিশনের সহ-সভাপতি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
এ পর্যন্ত এলডিপি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি এবং নাগরিক ঐক্যের সাথে আলোচনা করেছে কমিশন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গেও পর্যায়ক্রমে আলোচনা হবে। তবে শুধু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপই নয়, বরং কমিশনের কার্যক্রমে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে জরিপ চালানোর কথাও জানিয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও আগ্রহী জনগণ তাদের মতামত জানাতে পারবে। তিনি জানান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ২৯টি রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে। তারা আশা করছেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ রাজনৈতিক দল ও জোটগতভাবে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ হবে। এরপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী জুলাই মাসের মধ্যে কাজ শেষ করাই কমিশনের লক্ষ্য বলেও তিনি জানান। (কালের কণ্ঠ, ০৮ এপ্রিল ২০২৫ )।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে সংলাপ ও সংস্কার। কিন্তু এই সরকারের গত ৮ মাসে কোথায় কতটুকু সংস্কার দৃশ্যমান হলো বা কোথায় কোথায় সংস্কারের সূচনা হয়েছে—তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, সাধারণ মানুষের মনেও নানাবিধ প্রশ্ন আছে।
তাছাড়া সংস্কার বলতে আসলে কী বুঝানো হচ্ছে—সেটিও বিরাট প্রশ্ন। কেননা অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডাররা যেভাবে সংস্কারকে ব্যাখ্যা করছেন, তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বিএনপির ভাবনা ও অবস্থানে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং বিএনপি না চাইলে ওই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হবে কি না—তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এ পর্যন্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তার প্রত্যেকটি ডকুমেন্ট একেকটি বিরাট গবেষণা গ্রন্থের মতো। শত শত সুপারিশ। সবগুলো সুপারিশের সঙ্গে সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হবে না এটা যেমন ঠিক, তেমনি সবগুলো সংস্কার বাস্তবায়ন করতে গেলে কয়েক বছর লেগে যাবে। আবার রাজনৈতিক ঐকমত্য হলেও বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় সবগুলো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যাবে কি না—তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
ফলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আসলে সংলাপে যে আলাপটি করতে হবে তা হলো, তারা বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় কোন সংস্কারগুলোকে খুব জরুরি মনে করছে এবং একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য নির্বাচিত সরকার গঠনের জন্য কোন সংস্কারগুলো এখনই করতে হবে।
নির্বাচনের পরে একটি রাজনৈতিক দলের সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই সংস্কার শেষ হয়ে যাবে বা দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকবে—বিষয়টা এত সহজ নয়। মনে রাখতে হবে, যেসব কারণে একটি গণ-অভ্যুত্থান হলো এবং আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রবল পরাক্রমশালী দলের পতন হলো, সেই একই কারণগুলার পুনরাবৃত্তি ঘটলে পরবর্তী সরকারকেও হয়তো একইভাবে বিদায় নিতে হবে। সুতরাং সংলাপে এখন সবচেয়ে জরুরি আলাপের বিষয় হচ্ছে, অতীতের সরকারগুলো যেসব ভুল করেছে; রাষ্ট্রকে যেভাবে গণবিরোধী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে প্রাইভেট ও পরিবার লিমিটেড কোম্পানি বানিয়েছে; সংবিধানপ্রদত্ত জনগণের ক্ষমতা তথা রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা কেড়ে নিয়ে জনগণকে রাজনৈতিক দলের অধীন করেছে; রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ লুটপাটের মধ্য দিয়ে কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বঞ্চিত করেছে; নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে ক্ষমতাহীন করে ফেলেছে—সেই একই প্রক্রিয়া যাতে অব্যাহত না থাকে; যাতে দেশে সত্যিই একটি নতুন ধরনের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হয়, সেই আলাপটি জরুরি।
সংলাপে গিয়ে শুধু দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানানো যেমন কাজের কথা নয়, তেমনি সংস্কারের মুলা ঝুলিয়ে রেখে একটি অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থেকে যাবে—সেটিও কাঙ্ক্ষিত নয়। এখানে আলাপটি হতে হবে দেশের স্বার্থে। ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা থেকে যাওয়ার যে সাধারণ প্রবণতা—সেখান থেকে বের হয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নীতি ও কর্মপরিকল্পনা এবং সংস্কারের রোডম্যাপ তৈরির কোনো বিকল্প নেই।
দেশের মানুষ নিশ্চয়ই আরেকটি জুলাই অভ্যুত্থান দেখতে চায় না। আরেকটি অভ্যুত্থানে শত শত মানুষের প্রাণহানি চায় না। অতএব বিগত সরকারের ‘গণতন্ত্রের বিকল্প উন্নয়ন’ তত্ত্বের মতো ‘নির্বাচনের বদলে সংস্কার’ থিওরি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়াবে। এখন দূরত্ব বাড়ানো নয় বরং ঐক্যই কাঙ্ক্ষিত।
সুতরাং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণ তথা মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া যেমন জরুরি, তেমনি নির্বাচনের পরে আগের মতোই দেশ চলবে বা চালানো হবে—সেটিও আরেকটি বিপদের সূচনা করবে। ফলে সংলাপে এই আলাপগুলোই জরুরি যে, কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং সেই প্রতিনিধধিরা কীভাবে ‘রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক’ জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। দেশকে এগিয়ে নেবে। এই রোডম্যাপ ছাড়া একটি ভালো নির্বাচনও শেষমেষ অর্থহীন হয়ে যাবে।
আমীন আল রশীদ
সাংবাদিক ও লেখক।
সংলাপে কী আলাপ?
