কী এমন ছিল সালমানের মধ্যে যার জন্য তাকে আইডল হিসেবে দেখে সবাই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় সালমান শাহ অভিনীত সিনেমাগুলোতে। অনেকে সালমানকে শুধু স্টাইল আইকন হিসেবেই বিবেচনা করলেও তার সহজাত অভিনয় দক্ষতা ও চরিত্রের ভেতরে ঢুকে গিয়ে একদম চরিত্রে মিশে যাওয়ার গুণটা ছিল প্রবল। তাঁর প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত যারা দেখেছেন তারা খেয়াল করে থাকবেন যে সেখানে সালমান এতটাই সহজাতো ছিলেন যে কারো মনে হওয়ার উপায় ছিল না ওটাই ছিল তার প্রথম চলচ্চিত্র। কোন জড়তা ছাড়াই অভিনয় করে গেছেন প্রথম সিনেমাতেই। সালমান শাহ এর অভিনয় যাত্রা শুরু হয় আশির দশকের দিকে। হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় “কথার কথা” নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে গানের মডেল হন তিনি।
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন চৌধুরি মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ। অল্প বয়স থেকেই নাটকীয় শিল্পের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তিনি অভিনয়ের প্রতি তাঁর অনুরাগকে অনুসরণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ প্রোগ্রামে ভর্তি হন। এখানেই তিনি তাঁর দক্ষতা অর্জন করেন এবং বিনোদন শিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মজীবনের ভিত্তি স্থাপন করেন।
সালমান শাহ নামটি নব্বইয়ের দশকের প্রজন্মের কাছে এক আক্ষেপের নাম। যে নামটি শুনলেই প্রচণ্ড ভালোবাসার সাথে সাথে এক ধরনের হাহাকার কাজ করে। যিনি একটা প্রজন্মকে রোদ চশমা পড়া শিখিয়েছেন, যার রঙিন ভিউকার্ড দেখে দেখে রাত পার করে দিত ষোড়শী মেয়ে। সারা সপ্তাহ ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ছুটির দিনে যার ছবির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো পুরো পরিবার।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সলমন শাহের সিনেমা জগতে কর্মজীবন শুরু করেন এবং তিনি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন। সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ছবিটি তাৎক্ষণিকভাবে হিট হয় এবং সালমান শাহকে তারকাখ্যাতি এনে দেয়। অভিনেত্রী শবনুরের সঙ্গে পর্দায় তাঁর কেমেস্ট্রি প্রশংসিত হয় এবং এই জুটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে একটি আইকনিক জুটিতে পরিণত হয়।
যে বিষয়টি সলমন শাহকে আলাদা করেছিল তা হল অভিনেতা হিসাবে তাঁর অসাধারণ বহুমুখিতা। তিনি অনায়াসে বিভিন্ন ঘরানার মধ্যে রূপান্তরিত হন, তা সে ‘স্বপ্ন ঠিকানা’-র মতো রোমান্টিক নাটক, ‘বিচার হবে’-এর মতো অ্যাকশন-প্যাকড থ্রিলার বা ‘দেনমোহর’-এর মতো চিন্তার উদ্রেককারী চলচ্চিত্রই হোক না কেন। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার এই ক্ষমতা তাঁকে সব বয়সের এবং দর্শকদের কাছে প্রিয় করে তুলেছিল।
জটিল আবেগকে সত্যতার সঙ্গে প্রকাশ করার ক্ষমতা তাঁর ব্যতিক্রমী অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ ছিল। একজন প্রেমময় রোমান্টিক বা দ্বন্দ্বপূর্ণ নায়কের চরিত্রে অভিনয় করা হোক না কেন, তিনি প্রতিটি চরিত্রে একটি বাস্তব মানবতা নিয়ে এসেছিলেন।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে সালমানের প্রভাব কেবল তাঁর অভিনয় দক্ষতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি নতুন যুগের সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা আধুনিক গল্প বলার কৌশল এবং সিনেমাটোগ্রাফির একটি নতুন পদ্ধতির রূপ দেয়। দূরদর্শী পরিচালক ও প্রযোজকদের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দৃশ্যকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে সহায়তা করেছিল।
কখনো ছাত্রনেতা, কখনো প্রতিবাদী যুবক, কখনো গ্রামের ছেলে, কখনো প্রেমের জন্য ঘরছাড়া তরুণের চরিত্রে বড় পর্দায় দেখা দিয়েছেন দর্শককে। বেশিরভাগ ছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছিলেন নায়িকা শাবনূরের সাথে। কবরী-রাজ্জাক জুটির পর সালমান শাবনুর জুটিটাই এ দেশের দর্শকদের পছন্দের শীর্ষে এখনো রয়ে গেছে। শাবনূর ছাড়াও মৌসুমি শাহনাজ লিমা সহ একাধিক নায়িকার সাথে জুটি বেঁধেছেন। রোমান্টিক বেশি কাজ করলেও তার চরিত্রগুলোতে বৈচিত্র্য ছিল দেখার মতো। তার অভিনয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্র ছিল রোমান্স। সালমান-শাবনূর কিংবা সালমান মৌসুমীর রোমান্স দেখে হৃদয়ে প্রেম জাগেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মোটকথা একজন ভালো অভিনেতা বলতে যা বোঝায় সালমান শাহ ছিলেন তেমনি একজন।
ওটিটি হলিউড-বলিউডের যুগেও যার জনপ্রিয়তা একচুল কমেনি। বাঙালি দর্শকের মনে এখনও সেই আগের মতই জায়গা দখল করে আছে নায়ক সালমান শাহ। ক্ষণজন্মা এই নায়ক এক দশকের পুরোটা সময় নেননি ভালোবাসা কুড়োতে। মাত্র চার বছরে কয়েক দশকের নায়ক এর মধ্যে নিজের অস্তিত্ব জুড়ে দিয়ে গেছেন। কাউবয় হ্যেট, গগলস, লং কোট ডিটেকটিভ লুক, হুডি শার্ট, ব্যাকব্রাশ করা চুল, কানের দুল, ফেইড জিন্স, মাথার স্কার্ফ ফ্যাশন সেন্স সবকিছু মিলিয়ে এক অদেখা জোনের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল আপামর বাঙালি। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তারুণ্যের স্টাইল আইকন।
চার বছরে মোট ২৭ টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল তার। দুই একটা বাদে যার সবগুলোই ছিল সুপারহিট। অভিনয় দক্ষতা সংলাপের সাবলীলতা, সময় কে ছাড়িয়ে যাওয়া স্টাইল, ফ্যাশন দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে যিনি আসন গেড়ে বসে ছিলেন ক্রমেই বাংলা সিনেমা কে নিয়ে যাচ্ছিলেন নতুন উচ্চতায়। একঘেয়ে অভিনয় আর স্টাইল দেখতে দেখতে ক্লান্ত দর্শকদের সামনে তিনি হয়ে আসেন নতুনেরা আবাহন হিসেবে। তার রোমান্টিক, মেলোড্রামা, ফ্যামিলি ড্রামা, অ্যাকশন, প্রতিবাদ সব চরিত্র ছিল নতুনত্বের স্বাদ। সালমানের সিনেমাই শুধু অভিনয় আর ফ্যাশন নয়, গান ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার প্রতিটি সিনেমায় ছিল দারুণ সব গানে ভরপুর। অনেক গানে কালজয়ীতেই রূপ নিয়েছে ইতোমধ্যেই।
চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের আগেই ১৯৯২ সালের ২০ ডিসেম্বর বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী ছিলেন তার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হক। তার শ্বশুর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক উইকেটকিপার এবং অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা। সামিরা কিছু চলচ্চিত্রে সালমানের পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন চৌধুরি মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার, বিটিভিতে তখন শুক্রবারে বাংলা সিনেমা দেখার জন্য সবাই বসে থাকতো ছবি চলাকালীন বিকেল পাঁচটার খবরে সংবাদ পাঠকের কণ্ঠ ভেসে এলো দুঃসংবাদটা নায়ক সালমান শাহ আর নেই। এভাবে চলে যেতে পারে অনেকে বিশ্বাস করছিল না।
অনেকেই গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু যা ঘটে গেছে সেটা কোনো গুজব ছিল না, ছিল সত্য। সালমানের বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরি রমনা থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন। ময়নাতদন্ত শেষে রিপোর্টার আসে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু। কিন্তু সালমানের মা বাবা দুজনেই রিপোর্টের সন্দেহ প্রকাশ করে নারাজি জানান। ফলে বিচারক তার লাশ কবর থেকে তুলে আবারো ময়না তদন্তের নির্দেশ দেন। সিলেটের ওসমানী মেডিক্যালের ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার কৌশলগত কারণে তখন ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি ফলে সন্দেহটা গাঢ় হয়। আদালত থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে ঠিক। কিন্তু মৃত্যুর রহস্য যেন এখনও তাজাই রয়ে গেছে যেন অমীমাংসিতই মৃত্যুরহস্য কে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সিদ্ধান্ত। মীমাংসা হোক বা না হোক সালমান শাহ অমর হয়ে আছেন গানে, প্রেমে, আবেগে, ফ্যাশনে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আর ভক্ত হৃদয়।
যার প্রেমময় হাসিমুখ, যার অপরিমেয় জনপ্রিয়তায় বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে নায়কের নতুন সংজ্ঞা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ফ্যাশন স্টাইল অনুকরণীয় হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন অনেক আলোকিত ব্যক্তিত্ব, যার প্রভাব রুপালি পর্দার ঊর্ধ্বে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে একটি অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছেন। এরকমই একজন কিংবদন্তি ছিলেন প্রয়াত সলমন শাহ। চার বছরের ছোট ফিল্ম ক্যারিয়ারে যা করে গেছেন সাথে যে-সব নাটকে অভিনয় করে গেছেন সেগুলোই তাকে চির অমর অভিনেতার সম্মানে ভূষিত করার জন্য যথেষ্ট।