তিনি সুমধুর কন্ঠে গেয়েছিলেন ‘দিন যায় কথা থাকে…’ প্রকৃতির চিরায়ত নিয়মে দিন, মাস এবং বছরও চলে গেছে কিন্তু রয়ে গেছে তার কথা, সুর ও গায়কী। তিনি বাংলা গানের ইতিহাসের একজন কিংবদন্তি শিল্পী সুবীর নন্দী। তার চলে যাবার ৫টি বছর পূর্ণ হয়ে গেলো অথচ এখনো তার গায়কীর মধ্য দিয়ে তিনি রয়ে গেছেন আমাদের মাঝেই। একজন প্রকৃত শিল্পীর স্বার্থকতা তো এটাই।
১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মেডিক্যাল অফিসার সুধাংশু নন্দী ও পুতুল রানী দম্পতির ঘরে সুবীর নন্দীর জন্ম হয়। নিজের মায়ের কাছেই ৭-৮ বছরে সংগীতের হাতেখড়ি হয় তার। ঢাকা বেতার কেন্দ্রে রেকর্ডকৃত উনার প্রথম গান ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে যায়’ প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। যদিও এর আগে তিনি সিলেট বেতারে নিয়মিত ভাবে গান করতেন, সেখানেই তিনি সাহচর্য পেয়েছিলেন বিদিত লাল দাশ ও বাবর আলী খানের মতো সংগীত ব্যক্তিত্বর। সেই থেকেই সঙ্গীত জীবনের আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু সুবীর নন্দীর। একের পর এক দারুন কথা আর সুরের গান গেয়েছেন তিনি,যার বেশিরভাগই পেয়েছিল অসাধারণ শ্রোতাপ্রিয়তা।
বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘সূর্যগ্রহণ’ সিনেমায়। তবে ‘দিন যায় কথা থাকে’ সিনেমায় এই টাইটেল গান গেয়েই তিনি আক্ষরিক অর্থে সিনেমার গানে শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। এই গানের জন্য বাচসাস পুরস্কারও জয় করে নিয়েছিলেন। আমাদের চলচ্চিত্রের কালজয়ী ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার বিখ্যাত গান ‘ ও মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি তাকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে যায়। ‘লাল গোলাপ’ সিনেমার ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’ অথবা ‘উছিলা’ সিনেমার ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’ বা ‘মাটির মানুষ’ সিনেমার ‘বন্ধু হতে গিয়ে তোমার শত্রু বলে গন্য হলাম’ এর মতো কালজয়ী গান গেয়ে নিজেকে নিয়ে যান এক অন্য উচ্চতায়।
‘মহানায়ক’ সিনেমায় ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়,তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ এর মতো অসম্ভব জনপ্রিয় গান গেয়ে লাভ করেন প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দ্বিতীয় বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তোলেন ‘শুভদা’ সিনেমার ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’ গানের মধ্য দিয়ে। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমার ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানের সুবাদে তৃতীয় বারের মত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন সুবীর নন্দী। উল্লেখ্য এই গানটিকে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান বললে ভুল হবেনা। কারন এই প্রজন্মের মানুষের কাছেও তিনি এই গানটি দিয়ে এখনো সমানভাবে সমাদৃত এবং জনপ্রিয়। ‘মেঘের পরে মেঘ’ সিনেমায় ‘ভালোবাসি সকালে’ গানের জন্য চতুর্থবার এবং ‘মহুয়া সুন্দরী’ সিনেমা ‘তোমারে ছাড়িতে’ গানের জন্য পঞ্চম বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন তিনি।
‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া’, ‘পিঁপড়া খাবে বড় লোকের ধন’, ‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’ সহ অসংখ্য গানের মধ্য দিয়ে এখনো তিনি বেচে আছেন আমাদের মাঝে। আধুনিক সংগীতের পাশাপাশি তিনি শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন শাস্ত্রীয় সংগীত, ভজন, কীর্তন এবং পল্লীগীতিতেও। ব্যক্তিগত ভাবে নিজের ভালোলাগা এবং ভালোবাসার নজরুলসংগীতেও নিজস্বতা দিয়ে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়েছেন সুবীর নন্দী।
জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন এই শিল্পী। ব্যক্তিগত জীবনে গায়ক পরিচয়ের পাশাপাশি ব্যাংকার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়েছিলেন সুবীর নন্দী। গান ভালোবাসতেন, গাইতেন মন উজার করে তবে কখনোই যেনতেন গান গাইবার পক্ষে ছিলেন না তিনি। নিজের কাছে ভালো লাগলেই সেই গানটি গাইতেন নিজের মতো করে। কোয়ানটিটির থেকে কোয়ালিটি মেইনটেইন করা এই গুণী শিল্পীর মতো নিজেকে সংবরণ করার ক্ষমতা আমাদের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে খুব কম মানুষেরই আছে।
দীর্ঘ চার দশকের ক্যারিয়ারে ক্যাসেট, বেতার, টেলিভিশন এবং সিনেমা মিলিয়ে এই কিংবদন্তি গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও ২০১৯ সালে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অবদান স্বরুপ সরকারের তরফ থেকে পেয়েছিলেন একুশে পদক।
তবে সেই বছরই মানে, ২০১৯ সালের ৭ই মে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুবীর নন্দীর জীবনাবসান হয়। এই কিংবদন্তির চিরপ্রস্থান বাংলা সংগীত সুরের কখনোই পূরণ হবার নয়। তার শূন্যতা সংগীতাঙ্গন অনুভব করলেও এই শিল্পীর কর্ম ভাণ্ডারের জনপ্রিয় সব গানের মাঝেই তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন আজীবন।