নেই শত কোটি টাকার ব্যাংক ডিপোজিট! নেই ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো আধুনিক পরিকাঠামো, নেই তেমন কোনো স্পন্সর! নেই বড় দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলার সুযোগ। এমনকি নেই লাখ লাখ টাকার বড় কোচ। সেই নেদারল্যান্ডসের কাছেই কিনা হেরে বসেছে বাংলাদেশ। তাও ৮৭ রানের বিশাল ব্যবধানে। নেদারল্যান্ডস-আফগানিস্তানের ক্রিকেটাররা যেখানে দেশের প্রতি প্রগাঢ় মমত্ববোধ, ইস্পাতদৃঢ় চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, দায়িত্ব, আর হারার আগেই না-হারার অদম্য মানসিকতা একজোট করেই হারিয়ে দিতে পারে ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকাকে। সেখানে বাংলাদেশকে কিনা ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে একের পর এক প্রতিপক্ষ। টানা পাঁচ হারে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের ঘণ্টাও বেজে গেছে সাকিব বাহিনীর।
কিন্তু কেন এমন হলো? ক্রিকেটের অন্য দুই সংস্করণে যেমন-তেমন, তবে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ছিল সমিহ করার মতোই একটা দল। নিজেদের দিনে যারা হারিয়ে দিতে পারত বড় সব প্রতিপক্ষকেও। সাকিব-তামিমরা এই সংস্করণে কত শত সুখের ছবি উপহার দিয়েছেন ভক্তদের। আজ যেন সেই ঘরে এলিয়ে পড়েছে ছবি! কি এমন হলো-সেই সাজানো-গোছানো সংসারটা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল!
অথচ বিশ্বকাপ শুরুর আগে কি এক দারুণ রেকর্ডই না বাজিয়ে গিয়েছিলেন সাকিবরা-আমাদের লক্ষ্য সেমিফাইনাল। মুম্বাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের আগপর্যন্ত সেটিই বাজিয়ে গেছেন সারাক্ষণ। কিন্তু ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের কাছে হারের পরও একই কথা-বাকি ছয়টা ম্যাচের ছয়টাই তারা জিততে পারে। ভারতের কাছে হারের পরও ঘুম ভাঙেনি। তখনো একই কথা- বাকি পাঁচটা ম্যাচই জিতব। নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের পর সাঙ্গ হয়েছে স্বপ্ন। বিশ্বকাপের প্রথম দল হিসেবে বিদায়বার্তা-পেয়ে গেলেন সাকিবেরা।
বাংলাদেশ দলের এই অধপতনের পেছনে দলীয় সংহতি নষ্ট হওয়াটাকেই সবাই সামনে আনছেন। মাশরাফি পুরো দলটাকে একই ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিলেন। অনুপ্রেরণাদায়ী ক্যাপ্টেন হিসেবে সবার সুখ-দুঃখে পাশে থেকেছেন। তাঁর বিদায়ের পর ধীরে ধীরে সেটি কমলেও তামিমযুগেও সেটি অনেকটাই ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপের মাত্র কিছুদিন আগে তামিমের হুট করে বিদায়, আবার ফেরা, অধিনায়কত্ব ছাড়া, সাকিবের দায়িত্ব নেয়া, বিশ্বকাপ থেকে তামিমকে বাদ দেয়া-সুরের তালটা যেন কেটে যায় এখানেই। বিশেষ করে তামিমকে দল থেকে বাদ দেয়াটা এখনো মানতে পারেনি বাংলাদেশের সমর্থকেরা। বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলতে যাচ্ছে, দলের অন্যতম সেরা ব্যাটারকে ঘরে রেখে-মানবেই বা কি করে ভক্তরা। তামিম থাকলেই যে সবকিছু বদলে যেত তা না, কিন্তু বিশ্বকাপ তো বুঝিয়ে দিল-অভিজ্ঞতার মূল্য। কেননা বহু নাটকীয়তা শেষে বিশ্বকাপের দলে ঢোকা মাহমুদউল্লাহই যে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার।
হারের বৃত্তে ঢুকে পড়লে একটা সময় পাকিস্তান দলে ঘুরপাক খেত একটা কথা-কয়েকভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে দল। এখন সেই পাকিস্তানের রোগ নাকি ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের অন্দরমহলেও।
নেদারল্যান্ডসের কাছে হারার পর সাকিব আল হাসান যে ইঙ্গিত দিলেন সেটি তো তাই বলছে। সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে না পারা, বাজে ব্যাটিং, বোলিং—অনেক কিছুই নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের জন্য দায়ী। কিন্তু বিশ্বকাপে দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতার পেছনে বাংলাদেশ অধিনায়ক কিনা দায় দেখছেন জাতীয় দলে থাকা তামিম ইকবালের অনুসারীদের!
ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিশ্বকাপের আগে তামিমকে নিয়ে যে বিতর্ক হলো, তা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে অপ্রিয় কিছু কথা বলেছিলেন। তামিম আড়াই বছর অধিনায়ক ছিলেন। দলে তাঁর নিশ্চয়ই অনুসারী আছে। এটা কি দলে প্রভাব ফেলছে মনে হয়? এই প্রশ্নে সাকিবের উত্তর, ‘ফেলতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। একেকজনের মনে কী আছে বোঝা মুশকিল। আপনি যেটা বলছেন, সেটা আমি দ্বিমত করছি না। আসলে (প্রভাব) ফেলতেও পারে।’
সেই থেকেই বোঝা যায় দলের সেই তাল-ছন্দটা আর নেই। এ জন্য কঠিন হলেও একটা সত্যি মেনে নিলে সাময়িক সমস্যা হলেও হয়তো মিলবে দীর্ঘমেয়াদি ভালো ফল। সেটি হলো-বিশ্বকাপের পর সিনিয়র ক্রিকেটারদের ছাড়া দলটাকে এগিয়ে নেওয়ার ভাবনা ঠিক করা।
কে না জানে, মাহেলা জয়াবর্ধানে, কুমার সাঙ্গাকারা, দিলশানের সমসাময়িক সময়ে অবসরের পর শ্রীলঙ্কা কিছুটা বিপাকে পড়েছিল। কিন্তু উত্থান-পতনের সময়েই শ্রীলঙ্কা আবার গড়ে তুলেছে কুশাল মেন্ডিস, কুশাল পেরেরা, চারিথ আসালঙ্কা, পাতুম নিশাঙ্কা, ধনঞ্জয়ার মতো ক্রিকেটার। যারা আজ একের পর এক ম্যাচ জেতাচ্ছে, এশিয়া কাপে দলকে চ্যাম্পিয়ন করছে। তাই বাংলাদেশও হয়তো সিনিয়রদের ছাড়া কিছুদিন খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাবে। সেই প্রসববেদনা কাটিয়ে উঠলেই তো মিলবে দীর্ঘমেয়াদি সুফল!
আর হয়তো মিলবে-সিনিয়র ক্রিকেটারদের মান-অভিমান, বিবেধের দেয়ালমুক্ত পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ দলও।