বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতিতে অনিবার্য এক নাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বাংলার আপামর জনতা যাকে ‘বাংলার বুলবুল’ বলে সম্ভোধন করতো। রাজপথের মিছিলে, কখনো বা লাখো জনতার সমাবেশে স্লোগান ওঠত ‘বাংলার বুলবুল,সৈয়দ নজরুল’। রাজনীতিতে তার নেতৃত্ব, যোগ্যতা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন ছিলো না। ইতিহাসের পাঠ থেকেই জানা যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন তিনি। বয়সে ছোট হওয়া সত্বেও বঙ্গবন্ধু তাকে স্যার বলে ডাকতেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামও সভা-সমাবেশে শেখ মুজিবকে ‘প্রিয়তম বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। তার এই প্রিয়তম বন্ধুটি যখনই রাজনৈতিক কারণে রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত থাকতেন তখনই দায়িত্ব পড়ত তাঁর উপর। রাজনীতির কঠিন সেই মুহূর্তগুলো তিনি অত্যন্ত সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। যতোবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ততোবারই তাকে নিতে হয়েছে দলের দায়িত্ব।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালে ময়মনসিংহের যশোদল দামপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোরকাল কাটে গ্রামের পরিবেশে। তিনি ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
তিনি নিজ গ্রামের যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। পরে কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল। তিনি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।
রাজনৈতিক জীবন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ:
• আওয়ামী লীগে যোগদান: তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
• ভাষা আন্দোলন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
• ছয় দফা আন্দোলন: ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া ছয় দফা আন্দোলনে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
• মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারে তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ভাষা আন্দোলন থেকে সেই যে শুরু হলো এরপর ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থাণ, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপ ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন ইত্যাদি সবই তিনি করেছেন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় তাকে সংকাট-মানব হিসেবে অভিহিত করে। পত্রিকাটি চতুর্থ সংখ্যায় ‘সংকট-মানব সৈয়দ নজরুল’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয় ‘স্বাধীন-বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কর্ণধার সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাঙ্গালীদের কাছে একজন সংকট-মানব হিসেবে পরিচিত। বস্তুতঃ আওয়ামী লীগ ও বাঙ্গালী যখনই কোন সঙ্কটে পতিত হয়েছে তখনই তার ওপর অর্পিত হয়েছে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব। সহজ সরল নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি কথার চেয়ে কাজ করেন বেশি, চিন্তা করেন আরো বেশি।’
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যান্য নেতাদের সাথে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং তাঁর অবদান অমূল্য।সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।